ঢাকা
২৮শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রাত ৩:২৮
logo
প্রকাশিত : নভেম্বর ২৩, ২০২৫

একটি অপমৃত্যু ও ৩৫ ঘন্টা নেটওয়ার্কের বাইরে থাকার গল্প

সংবাদ ছিলো নাপাখুম ঝর্ণায় গোসল করতে গিয়ে এক ব্যক্তি পা পিছলে পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার। গহীন পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় আর থানা থেকে নৌকা ও হাঁটার পথে প্রায় ৫ ঘন্টার অধিক দূরত্বের পথ হওয়ায় প্রয়োজনীয় উপাদান এবং ফায়ার সার্ভিসের লোকজনসহ নৌকাযোগে রওয়ানা করলাম রেমাক্রির উদ্দেশ্যে। রেমাক্রির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আগে পারিবারিক মেসেঞ্জার গ্রুপে জানাই যে আমাকে আজ রাতে নেটওয়ার্ক এ পাবে না (তখন জানতাম না যে টানা ৩৫ ঘন্টা নেটওয়ার্ক এর বাইরে থাকা লাগবে)।

রোমাক্রি যখন পৌঁছাই ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। সেখান থেকে নৌকাযোগে সেখানকার বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরাসহ নৌকাযোগে নাপাখুম এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি। যাওয়ার পথে পানি স্বল্পতায় নৌকা পাথরে আটকে যাওয়ার কারণে চারবার নৌকা থেকে নেমে কখনো পাহাড়ি ছোট রাস্তা ধরে হাঁটা এবং কখনো নদীর ঝিরি হয়ে হেঁটে যখন নৌকার পথ শেষ হয় তখন রাত প্রায় ৭:৩০ বেজে যায়।এর মাঝে নৌকা থেকে নামার সময় অন্ধকার হওয়ার কারণে কয়েক বার চোরাবালি (আসলে কাদা) তে আটকে কাপড়চোপড় সব নষ্ট হয়ে যায়। সেখান থেকে অন্ধকার পাহাড়ি এলাকার সরু রাস্তা ধরে মোবাইল ও টর্চের আলোতে প্রায় ৪০/৪৫ মিনিট পায়ে হেঁটে যখন নাপাখুৃম পৌঁছাই তখন শরীরে শক্তি বলতে অবশিষ্ট কিছু কারো ছিলো বলে মনে হয় না।

নাপাখুম পৌঁছে স্থানীয় লোকজন এবং ভিকটিমের পরিচিত লোকজনসহ জলপ্রপাতের দিকে যখন যাই তখন জলপ্রপাতের ভয়ংকর রূপ দেখেই বুঝতে পারি একজন মানুষ উপর থেকে নিচে গেলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে! তাও আশায় বাঁচে মানুষ, সেই আশা নিয়ে ভিকটিমকে খোঁজ করার কার্যক্রম শুরু করলাম। ভিকটিমের পরিবারের চাহিদা ছিলো অন্তত লাশটা যেন উদ্ধার করে দেওয়া হয় এবং আমি তাদেরকে বারবার আশা দিয়ে যাচ্ছিলাম আর ভাবতেছিলাম কিভাবে কি করবো।

রাত হয়ে গেলো এর মাঝে, পাড়ার লোকজনের আন্তরিকতায় সবাই অল্প খাওয়া দাওয়া ও করলাম এবং লোকাল কটেজে থাকার ব্যবস্থা ও হয়ে গেলো। সবাই রুমে গিয়ে পোশাক চেঞ্জ করে একটু রেস্ট করে পাড়ার লোকজন এবং স্থানীয় গাইডদের টিমসহ রাত্রিবেলা চারটা আলাদা পার্টি হয়ে নদীতে যতটুকু প্রায় দুই কিলো পথ খোঁজাখুঁজি করলাম। না পেয়ে হতাশ হয়ে সেই রাতের মতো অভিযান সমাপ্তি করে সবাই ঘুমাতে গেলাম, তার আগেই ওয়ারল্যাসে বার্তা পাঠানো হলো যদি লাশ (ভিকটিম মারা গেলে) ভেসে না উঠে তাহলে ডুবুরি ছাড়া এই লাশ পাওয়ার সম্ভাবনা নাই।

সকালে ভোরেই সবাই উঠে গেলাম ঘুম থেকে এবং সম্ভাব্য যতটুকু স্থানে লাশ ভেসে উঠার সুযোগ ছিলো ততটুকু পথ সবাই মিলে হাঁটলাম, কিন্তু লাশের কোন সন্ধান পেলাম না। আমরা বুঝতে পারলাম ডুবুরি ছাড়া লাশের সন্ধান পাওয়া সম্ভব না তাও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় নৌকা নিয়ে গাইড স্থানীয় লোকসহ সবাই যতটুুকু সম্ভব পানিতে নেমে খোঁজাখুঁজি করার পরও কোন হদিস পেলাম না। এর মাঝে একদল গাইড থানচি সদরে আসতেছিলো তাদের মাধ্যমে আমরা সবাই আমাদের পরিবারের নাম্বার কাগজে লিখে দিলাম এবং বললাম থানা থেকে যেন ফোন করে পরিবারকে জানানো হয় যে আসতে কয়দিন সময় লাগতে ও পারে (লাশ পাওয়া না গেলে এই লাশ ভেসে উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগতো আমাদের হয়তো)।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো, বিকেল হওয়ার আগেই ডুবুরি'রা পৌঁছাইলো চট্টগ্রাম থেকে এসে, আর ডুবুরি'রা পৌঁছাইতেই তারা খাওয়া দাওয়া না করেই তাদের অভিযানের কার্যক্রম শুরু করে দিলো এবং আমরা সবাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেছিলাম যেন, যেকোন ভাবে লাশটাকে অন্তত পাওয়া যায় এবং পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দিতে পারি। ডুবুরি দলের অভিযানের ৩৫ মিনিটের মাথায় খুমের পাথরের ভাজের ভিতর থেকে লাশ উদ্ধার হলো আর তখনি শুরু হলো সকলের গগনবিদারী কান্না।

সন্ধ্যা হয়ে আসতেছিলো, কালবিলম্ব করার সুযোগ ছিলো না তাই তাড়াতাড়ি আমার লেখালেখির কাজ শেষ করে নাপাখুম হতে নৌকাঘাট পর্যন্ত এই পথটা আসার জন্য স্থানীয় লোকজনের হেল্প চাইলাম এবং ওনারা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের হেল্প করলো। ওনাদের সহযোগিতায় যখন প্রায় এক ঘন্টা পাহাড়ি পথ ধরে হেঁটে আমরা নৌকা ঘাটে পৌঁছাইলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। সেখান থেকে অন্ধকার নদী দিয়ে টর্চের আলোতে লাশসহ রেমাক্রি পৌঁছাইলাম। আবার লাশ নৌকা চেঞ্জ করে রেমাক্রি হতে আলাদা নৌকা নিয়ে প্রায় আড়াই ঘন্টার পথ আল্লাহ আল্লাহ করতে-করতে লাশসহ যখন থানায় পৌঁছাইলাম তখন দেখি ঘাটে আমাদের অপেক্ষায় অনেক মানুষ। নৌকা হতে লাশ উপরে তুললাম এবং আলাদা গাড়িতে করে থানায় নিয়ে গিয়ে আইনগত কার্যক্রম সম্পন্ন করে যখন পরিবারের নিকট বুঝিয়ে দিই তখন ভিকটিমের পরিবারের সদস্যদের দেখানো সম্মান এবং তাদের ভালোবাসা দেখে আমার কাছে মনে হলো "আমার আল্লাহ আমাকে নিশ্চয়ই ভালোবাসে" না হয় এমন একটা ভালো কাজ আমাকে দিয়ে করাতেন না।

কয়েকটা পরামর্শ দিই-
১) পাহাড়ি এলাকায় যেসব এরিয়া সরকারিভবে নিষেধ করা আছে, দয়া করে কেই এসব এরিয়া তে রিস্ক নিয়ে যাবেন না। মনে রাখবেন সৌন্দর্য অবলোকন করার চাইতে আপনার সেইফটি আগে।

২) সাঁতার যদি না জানেন কাল থেকেই সাঁতার শিখুন।

উল্লেখ্য, নেটওয়ার্ক এ এসে যখন আমার মা কে ফোন দিয়ে বললাম, "আম্মু আমি নেটওয়ার্ক এ পৌঁছাইছি, তখন আমার মা আলহামদুলিল্লাহ বলে যে চিল্লানি টা দিছে এতটা খুশি আমার মা জীবনে কখনো হইছে কি না আমার জানা নাই। আসলে লং টাইম যোগাযোগ না থাকার কারণে ওনারা অস্থির হয়ে গেছিলো। থানায় আসার পর জানতে পারলাম ওনারা টেনশনে বারবার থানায় যোগাযোগ করতেছিলো।"

রিয়াজুল নয়ন
সাব ইনস্পেক্টর
থানচি থানা, বান্দরবান

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ এডভোকেট মো: গোলাম সরোয়ার
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram