

আজ আকাশের মেঘ যেমন তার ভার বইতে না পেরে একসময় ঝরে পড়ে, তেমনি গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের লাখো মানুষ তাদের মাথার উপর চেপে বসা এক অসহনীয় আর্থিক বোঝায় নীরবে কাঁদছে। সেই বোঝার নাম—প্রিপেইড বৈদ্যুতিক মিটার। পুরোনো পোস্টপেইড বিলের দিনগুলোতেও যেটুকু স্বস্তি ছিল, হিসেবের স্বচ্ছতা ছিল, আজ তা এক 'ভুতুড়ে বিলের' অন্ধকারে বিলীন। ২০১৫ সাল থেকে যখন এই প্রযুক্তির সংযোগ বৃহৎ পরিসরে দেওয়া শুরু হলো, তখন মানুষ জানতো না, তাদের জীবনে এ কীসের আগমনী বার্তা নিয়ে এলো। শহরের চকমকে ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে গ্রামের মাটির ঘর—সকলের কপালেই যেন চিন্তার ভাঁজ এঁকে দিয়েছে এই যন্ত্র।
পোস্টপেইড মিটারে যেখানে মাস শেষে একটি পরিবার মাত্র ২,০০০ থেকে ২,৫০০ টাকা বিল দিতো, সেখানে প্রিপেইড মিটারের আগমন এক ধরনের অর্থনৈতিক ধাঁধা হিসেবে আবির্ভূত হলো। সমপরিমাণ বা এমনকি কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেও এখন বিল আসছে ৭,০০০ থেকে ৮,০০০ টাকা, যা কোনো সরল গাণিতিক ভুল নয়—এ যেন সাধারণ মানুষের পকেটে ছুরি চালানোর এক নীরব ষড়যন্ত্র।
তথ্য-উপাত্ত স্পষ্টভাবে বলছে, এর পেছনে কেবল যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, বরং গভীর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে। ২০১৫-২০১৬ সালে শহরাঞ্চলে ডিমান্ড চার্জের তারতম্য নিয়ে প্রথম প্রশ্ন উঠার পর থেকেই এই ভোগান্তির সূচনা। ঢাকার সংবাদপত্রগুলো, যেমন ঢাকা মেইল, দেখিয়েছে, এক কিলোওয়াট বিদ্যুতের জন্য ডিমান্ড চার্জ যা পোস্টপেইডে মাত্র ৪৫ টাকা ছিল, তা প্রিপেইডে বেড়ে হয়েছে ১২৬ টাকা, অর্থাৎ আড়াই গুণেরও বেশি। এটাই হলো প্রথম আঘাত—যেখানে সাধারণ মানুষের ঘরে বসে, বোঝা ছাড়াই, অযাচিতভাবে টাকা বেরিয়ে যেতে শুরু করে। প্রতিটি ঘরে এই নতুন মাপের উদ্বেগ, প্রতিটি পরিবারে এক অদৃশ্য অর্থনৈতিক জঞ্জাল। একসময় যা ছিল স্বাভাবিক জীবনধারা, আজ তা পরিণত হয়েছে অপ্রত্যাশিত আর্থিক বেদনার এক ধারাবাহিক ধাক্কায়।
এই অন্যায় যেন কেবল শহরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ২০১৭-২০১৮ সাল নাগাদ যখন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)-এর মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে এর বিস্তৃতি ঘটে, তখন গ্রামীণ মানুষের জীবনেও নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। যেখানে শহরের মানুষ অন্তত অভিযোগ জানানোর সুযোগ পান, সেখানে গ্রামের নিরীহ মানুষেরা বিতরণের অফিস অনেক দূরে থাকায় তাদের অভিযোগের প্রায় ৮০% ক্ষেত্রে কোনো প্রতিকার না পেয়ে নীরবে বিল শোধ করে গেছেন। গ্রামীণ এলাকায় মিটার ব্যাটারি নষ্ট হওয়া একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল, যার কারণে বিদ্যুৎ না থাকার ভোগান্তি ৩-৪ দিন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়েছে।
এই সমস্যার মূলে লুকিয়ে আছে সেই অদৃশ্য, নীরব ‘চার্জ’। মানুষ যখন ভাবল, সঠিক মূল্য দিয়ে তারা বিদ্যুৎ পাবেন, তখনই ধাক্কা আসে—১০০০ টাকা রিচার্জ করলে হাতে আসে মাত্র ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা, অর্থাৎ মুহূর্তেই ১০-১৫% টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করে, এই টাকা চলে কোথায়? কিন্তু কোনো সঠিক উত্তর নেই। এই খামের টুকরোগুলো চলে যাচ্ছে ‘মিটার ভাড়া’, ‘সার্ভিস ফি’, ‘ভ্যাট’, আর সেই বিতর্কিত ‘ডিমান্ড চার্জ’-এর আড়ালে।
একটি ছোট্ট ঘটনা মনে পড়ে—সাল ২০২৪, ডিসেম্বরের শেষ। শীতের রাত, একজন মধ্যবিত্ত মা জরুরি কাজে ব্যালেন্স ব্যবহার করলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ৫০ টাকা অতিরিক্ত চার্জ কেটে নেওয়া হলো। তিনি বুক চিত্কার করে বললেন, “আমি কি নিজস্ব নিয়মে এত টাকা হারাতে চাই?”—কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি’র কোনো হস্তক্ষেপ নেই।এই অতিরিক্ত বিলের ছায়ায়, বিতরণ সংস্থাগুলি তাদের নিজস্ব ৫-১০% সিস্টেম লসকে গ্রাহকের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে—যে চাপটি প্রতিদিনের জীবনের মধ্য দিয়ে মানুষকে ধীরেধীরে নিঃশ্বাসকষ্টে ফেলে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের ঘরে, সেই অদৃশ্য আঘাত প্রতিনিয়ত বাজে, আর আর্থিক নিরাপত্তার ধারণা যেন ধ্বংসের প্রান্তে।
২০২০-২০২২ সাল ছিল এক ভয়াবহ সময়। যখন করোনা মহামারীর কারণে মানুষের আয়ে চরম টান, ঠিক তখনই বিলের বোঝা আরও বাড়তে থাকে। অর্থনৈতিক চাপ এবং উচ্চ বিদ্যুৎ স্ল্যাবের কারণে মানুষের গড় মাসিক অতিরিক্ত খরচ ৪০০টাকা থেকে ৬৫০টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আর ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে এই অঙ্কটি আরও বড় আকার ধারণ করে, যেখানে অনেক পরিবারকে গড়ে ৬০০টাকা থেকে ১০০০টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত বিল দিতে হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে নিম্নমানের মিটারের কারসাজি; একাধিক পরীক্ষণে দেখা গেছে, এই সস্তা মিটারগুলোতে ২% থেকে ১০% পর্যন্ত 'ফাস্ট রিডিং' দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে, যা গ্রাহকের অজান্তেই তার পকেট খালি করে।
এই অনিয়মের ফলে দেশে একটি আর্থিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে। অতিরিক্ত বিলের মাধ্যমে সংগৃহীত কোটি কোটি টাকা প্রথমে বিতরণ সংস্থার খাতায় 'বকেয়া আদায়' হিসেবে দেখানো হলেও, এর বড় একটি অংশ নিম্নমানের মিটার উচ্চমূল্যে ক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার চক্রে চলে যাচ্ছে। ২০২৪-২০২৫ সালের দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এভাবে ৫০০টাকা কোটি টাকারও বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। এই আর্থিক শোষণ কেবল ব্যক্তিকেই দুর্বল করছে না, তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকেও দুর্বল করছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যা বাজারে চাহিদা কমিয়ে পরোক্ষভাবে মুদ্রাস্ফীতিকে ১-২% পর্যন্ত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিদ্যুৎ এখন আর মৌলিক সুবিধা নয়, এটি জিম্মির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যেখানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে মানুষ মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত।
যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে, তবে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রিপেইড মিটারের প্রতি জনগণের আস্থা প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছাবে এবং এটি রাষ্ট্রের নাগরিক সেবার প্রতি মানুষের আস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করবে। ২০৪০ সাল নাগাদ যদি এই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার সমাধান না হয়, তবে এই খাতটি দেশের অর্থনীতিতে একটি স্থায়ী বোঝা হিসেবে বিবেচিত হবে। এই সমস্যাটি কেবল প্রযুক্তির ত্রুটি নয়, এটি সেই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের ফল, যারা নিজেরা লাভবান হতে গিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন কেড়ে নিচ্ছে।
তবুও, মানুষের এই অসহায় কান্না একদিন শেষ হবেই। প্রয়োজন একটি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, একটি সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। হে স্বদেশ, তোমার বুকে আজও জ্বলছে অন্যায়ের বিদ্যুৎ! আমাদের পকেট থেকে চুরি যাওয়া প্রতিটি মুদ্রার হিসেব একদিন নেবে এই জনগণ। ভয়কে জয় করে, চোখের জল মুছে আজ আমরা রুখে দাঁড়াবো এই শোষণের বিরুদ্ধে। যেখানে আমাদের আলো, সেখানেই আমাদের শক্তি—আর সেই শক্তি দিয়েই আমরা ভাঙব এই অন্যায়ের জিম্মিদশা। মনে রেখো, আমরা আলোর গ্রাহক, জিম্মি নই!
লেখক
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব
সহকারী অধ্যাপক
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
দাউদ ইব্রাহিম হাসান
অর্থনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

