ঢাকা
১৫ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রাত ২:১৭
logo
প্রকাশিত : নভেম্বর ৫, ২০২৫

‘জাদুর মেশিন’ নয়, এটি আপনার জীবনের ডেথ-ওয়ারেন্ট!

'সুচিকিৎসার সবচেয়ে বড় শর্ত নির্ভুল রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা'– কথাটি যখন বলি, তখন কি আমরা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে একবারের জন্যও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি? যে দেশে মানুষের জীবন নিয়ে চরম উদাসীনতা আর সীমাহীন মুনাফার লোভ এক ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছে, সেখানে স্বাস্থ্যসেবা যেন এক দুঃস্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। ভাবুন তো একবার, আপনার শারীরিক অসুস্থতা ধরা পড়ার জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে মাত্র ২০ হাজার টাকা দামের একটি সস্তা মেশিনের উপর! যে যন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে স্বয়ং অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরাও শিউরে ওঠেন, সেই 'জাদুর মেশিন' দিয়েই চলছে জীবন-মৃত্যুর ফয়সালা। এটি কোনো রূপকথা নয়, এটি আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে গজিয়ে ওঠা এক শ্রেণির বিনা পারমিশনের ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং মেডিকেলগুলোর প্রতিদিনের চিত্র।

চীনের তৈরি পিওসিটি (POCT) নামক এই যন্ত্রটি কম দামে পাওয়ার কারণে দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা এটিকে সিন্দুকে রেখে লক্ষ্মীলাভ করছেন। অথচ এই যন্ত্রটি নাকি হৃদরোগ, থাইরয়েড, প্রজনন স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে ক্যান্সারের মতো জটিলতম দশ ধরনের রোগের ষাট ধরনের নমুনা পরীক্ষা করতে সক্ষম! শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও, ঢাকার উত্তরার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলেও গোপন সূত্রে এই যন্ত্রের ব্যবহার ধরা পড়েছে। চীনা প্রতিষ্ঠান বনফোর (Bonfor) তৈরি ফাইনকেয়ার টু নামে পরিচিত এই যন্ত্রটি ৫৬ ধরনের রোগের পরীক্ষার সক্ষমতা রাখে বলে দাবি করা হয়। যেমন, ডায়াবেটিস পরীক্ষার জন্য মাত্র ৩০০ সেকেন্ড (৫ মিনিট) এবং হৃদরোগের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় লাগে— ভাবুন, কত দ্রুত এই ভুল পরীক্ষার জাল বোনা হচ্ছে!

কিন্তু দ্রুত আর সস্তার ফল যে কত বিষময় হতে পারে, তা ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কেই-বা জানে? এই যন্ত্রের পরীক্ষার ফল প্রায়শই সম্পূর্ণ ভুল আসে। একটি ভুল রিপোর্ট একজন মানুষকে কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতে পারে, তার সাক্ষী গ্রাম থেকে শহরের সেইসব অসহায় মানুষ, যারা দিনের পর দিন ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সুস্থ মানুষও এই সস্তা যন্ত্রের ভুল রিপোর্টের ভিত্তিতে ক্যান্সার না হয়েও ক্যান্সারের চিকিৎসা পেয়েছেন! হয়তো তার হয়েছিল সাধারণ একটি রোগ, কিন্তু তাকে ক্যান্সার বলে আখ্যা দিয়ে, গুরুতর অপারেশনের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। যখন ডাক্তাররা বুঝতে পারলেন যে রোগটি ক্যান্সার নয়, তখন তারা দ্রুত রোগীকে ছেড়ে দিলেন, যেন বিশাল একটি সার্জারির ভুল ধামাচাপা দেওয়া যায়।

এ কী ভয়ানক চিত্র! যন্ত্রের ভুলের কারণে ডাক্তারের সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হলো, আর তার দায় গিয়ে পড়লো রোগীর উপর। ভুল চিকিৎসার ফলস্বরূপ রোগীর স্বাস্থ্য যখন হুমকির মুখে, তখন ডাক্তাররা রোগীকে পরবর্তী চিকিৎসা দিতে আগ্রহ দেখান না। উল্টো, দুর্ব্যবহার করে তাদের তাড়িয়ে দেন, যেন ভুক্তভোগীরা আর কখনও চিকিৎসার জন্য না আসে। কারণ তারা জানেন, ভুল চিকিৎসা দিয়েছেন এবং এর পরিণতি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

এই যন্ত্রের দুর্বলতা আরও ভয়ংকর— একই নমুনায় এক এক সময় ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল দিচ্ছে। ফলে কোনটি সঠিক, আর আদৌ কোনো ফল সঠিক কিনা, তা বের করা রীতিমতো অসম্ভব। একই সময়ে একই নমুনা যখন একটি আধুনিক মেশিনে পরীক্ষা করা হলো, তখন ফলাফল আসলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন, ক্যান্সারের চিকিৎসায় যখন একটি আধুনিক যন্ত্রে পারসেন্টেজ রেট পাওয়া গেছে ১১.৭৩, তখন এই ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রে তা দেখানো হয়েছে ১৯.২৪! আকাশ-পাতাল এই পার্থক্য প্রমাণ করে, সামান্য লাভের জন্য এই যন্ত্র ব্যবহার করে ল্যাবগুলো প্রতিদিন মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই যন্ত্র ব্যবহারকারী তিনটি ল্যাবরেটরীতে একই নমুনা একই সময় প্রতিবেদন দিল তিন রকম— যেখানে যন্ত্রই ভুল, সেখানে সঠিক ফল আশা করা কি বোকামি নয়?

তবে কেন এই যন্ত্রের রমরমা বাণিজ্য? উত্তর লুকিয়ে আছে সেই লাভের খাতায়। যেখানে এই মেশিনের দাম মাত্র দেড় লক্ষ টাকা, সেখানে এর এজেন্টরা নাকি দেশে প্রায় ১৫ হাজার যন্ত্র বিক্রি করেছে বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে! কম খরচে বিপুল লাভের আশায় ল্যাবগুলো এই ভুল যন্ত্র কিনছে। রোগীরা একটি ভুল পরীক্ষার জন্য গুনছেন প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা, অথচ এই পরীক্ষার জন্য সর্বোচ্চ দাম ধার্য করা আছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। অর্থাৎ, চার গুণ লাভ তুলে নেওয়া হচ্ছে এই ভুল পরীক্ষাগুলো থেকেই।

দেশের ল্যাবরেটরির অপারেটর ও টেকনোলজিস্টরাও বোঝেন যে এই যন্ত্রের ফল সঠিক নয়। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ হেলথ সায়েন্স এর ফিজিওলজি এবং মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোঃ সাইদুল্লাহ মন্তব্য করেছেন, "রেফারেন্স ল্যাব অথবা কোনো প্রতিষ্ঠিত ল্যাবে এই যন্ত্রের কোনোভাবেই কোনো প্রকার ব্যবহার থাকা উচিত না।" এটি কেবলই প্রাথমিক পরীক্ষার জন্য, অর্থাৎ পেরিফেরিতে বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে চলছে এর ব্যাপক অপব্যবহার। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেন্স সেন্টার-এর সরকারি টেকনিশিয়ানরা এই যন্ত্রের ফলাফল দেখে রীতিমতো হতবাক হয়ে যান।

সীমাহীন মুনাফার লোভে সস্তা, অনির্ভরযোগ্য ও ভুল যন্ত্রগুলো দিয়ে শুধু রোগীদের বিপদে ফেলা হচ্ছে না, এর দ্বারা পুরো স্বাস্থ্য খাতকেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়া হচ্ছে। ভুল চিকিৎসার ফলে একজন মানুষের জীবনে নেমে আসা অকাল মৃত্যু কিংবা অঙ্গহানির দায়ভার কার? রোগী তো কেবল বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হচ্ছেন। আর কতকাল আমরা শুধু দাঁড়িয়ে দেখব জীবনহানি? আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ, প্রতিটি রক্তবিন্দুর মূল্য আছে। যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমাদের আস্থা আর ভরসার জায়গা হওয়ার কথা ছিল, আজ তা লোভ আর ভুলের কালো ছায়ায় ঢেকে গেছে। এবার ঘুরে দাঁড়ানোর সময়! প্রতিটি ভুক্তভোগীর কান্না, প্রতিটি ভুল রিপোর্টের দাগ, আর প্রতিটি অকাল মৃত্যুর দায়ভার যেন আমাদের বুকে বিদ্রোহের আগুন জ্বালায়। জেগে উঠুন, প্রশ্ন করুন, দাবি করুন— নির্ভুল রোগ নির্ণয়ের অধিকার প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই ভুল চিকিৎসার জাদুকরদের মুখোশ টেনে খুলে ফেলুন, কারণ আমাদের জীবন কোনো সস্তা পরীক্ষার ফল নয়!

লেখক
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব
সহকারী অধ্যাপক
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

দাউদ ইব্রাহিম হাসান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ এডভোকেট মো: গোলাম সরোয়ার
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram