ঢাকা
১৪ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রাত ৯:৫১
logo
প্রকাশিত : নভেম্বর ১৩, ২০২৫

গণপরিবহনে কেন ভয়, নারীর নিরাপত্তা আসলে কোথায়?

আমাদের শহরের আনাচে-কানাচে প্রতিদিন সকালে একটি সাধারণ দৃশ্য দেখা যায়—অফিসগামী বাবা তার মেয়েকে বাসে তুলে দিচ্ছেন। তাদের চোখে থাকে স্বপ্ন আর মুখে থাকে আশ্বাস, “সাবধানে যাস, মা।” কিন্তু বাসের ভিড়ে সেই আশ্বাস কেমন যেন ফিকে হয়ে আসে। মেয়েটি তার চারপাশে তাকিয়ে দেখে এক গাদাগাদি ভিড়, যেখানে শ্বাস নেওয়াও কঠিন। অথচ এই ভিড়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অজানা এক আশঙ্কা। মিতু নামের একটি মেয়ে, যে রোজ এই পথ দিয়ে কলেজে যায়, তার জীবনও এই বাস্তবতার প্রতিফলন। তার বাবা স্বপ্ন দেখেন, মিতু একদিন বড় চাকরি করবে, তাদের সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু মিতু বাসে উঠলে তার মনে শুধু ভয় আর অস্বস্তি। সে দেখে, কীভাবে কিছু অসংবেদনশীল হাত তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে, কীভাবে কিছু কদর্য চোখ তাকে অনুসরণ করছে। এই যন্ত্রণা শুধু মিতুর একার নয়, এটি লাখো মিতুর গল্প। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা কতটা হুমকির মুখে, তা কি আমরা সবাই সমানভাবে উপলব্ধি করি?

এই সমস্যাটি শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি সমাজের প্রতিটি স্তরে বিষাক্ত প্রভাব ফেলছে। একজন নারী যখন কাজ বা শিক্ষার জন্য ঘরের বাইরে বের হন, তখন তার প্রথম চ্যালেঞ্জই হয় গণপরিবহন। এই অনিরাপদ পরিবেশ তাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেয়, তাদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণকে সীমিত করে এবং তাদের স্বপ্নকে অকালে হত্যা করে। এর ফলে শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একটি জাতি তখনই উন্নতি করতে পারে যখন তার অর্ধেক জনসংখ্যা, অর্থাৎ নারীরা, সমান সুযোগ এবং নিরাপত্তা পায়। এই সমস্যাটি যদি সমাধান না হয়, তাহলে আমাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডগুলো এক ধরনের স্থবিরতার মধ্যে চলে যাবে। আমাদের সমাজ, পরিবার এবং জাতি হিসেবে আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব হলো এই গভীর সমস্যাকে উপলব্ধি করা এবং এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।

১৫ বছর আগেও বাংলাদেশের গণপরিবহনে নারীদের জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না। তখন নারী যাত্রীর সংখ্যাও ছিল কম। কিন্তু বর্তমান সময়ে চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা অনুসারে, প্রায় ৯০% নারী গণপরিবহনে কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার হন। এই হয়রানি মৌখিক, শারীরিক এবং মানসিক—সব ধরনেরই হতে পারে। বাসের হেলপার, কন্ডাক্টর, এমনকি সহযাত্রীর দ্বারাও এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে।

২০১৮ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৯৪% নারী যাত্রী বাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ছিল অপ্রীতিকর স্পর্শ, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি। এই পরিস্থিতি তাদের কর্মস্থলে পৌঁছানোর আগেই মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্ত করে ফেলে। অনেক নারী তাই বাধ্য হয়ে কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করেন বা চাকরি ছেড়ে দেন। এটি আমাদের সমাজের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা। অথচ আমরা ভুলে যাই, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীরাই একটি দেশের উন্নতির চালিকাশক্তি। এই সমস্যার পেছনে শুধু অসচেতনতা নয়, বরং একটি অসুস্থ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাও কাজ করে।

যদি এই সমস্যার সমাধান না হয়, তবে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী এবং ভয়াবহ। ভবিষ্যতে গণপরিবহন নারীদের জন্য আরও অনিরাপদ হয়ে উঠবে, যা তাদের চলাফেরা আরও সীমিত করবে। এর ফলে নারীর শিক্ষা এবং কর্মজীবনে অংশগ্রহণ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে, ছাত্রসমাজ সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে। অনেক ছাত্রী পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে, কারণ তারা প্রতিদিন এই দুঃসহ অভিজ্ঞতা সহ্য করতে পারবে না।

বর্তমানে, এমনকি শিশুরাও এই সমস্যার শিকার হচ্ছে। অল্পবয়সী মেয়েদের ওপর যৌন হয়রানি একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের অভিজ্ঞতা শিশুদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, যা তাদের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে তারা সমাজবিমুখ এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে। এই সমস্যার সমাধান না হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা একটি ভীত ও ভঙ্গুর সমাজ উপহার দেব। এর ফলে সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাবে এবং এটি একটি সাধারণ সংস্কৃতিতে পরিণত হবে। যখন একটি সমাজ তার নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সে সমাজের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

বর্তমান এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুধু সরকার বা নির্দিষ্ট কোনো সংস্থার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষেরই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ১৫ বছর আগে হয়তো নারীদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিল না, কিন্তু বর্তমানে ৯০% নারী হয়রানির শিকার হওয়ার পরেও আমরা কি এ ব্যাপারে যথেষ্ট সোচ্চার? সাধারণ জনগণ, শিক্ষার্থী, পরিবহন শ্রমিক এবং বিভিন্ন গঠনমূলক সংস্থা—সকলের সম্মিলিত উদ্যোগই পারে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে।

কিন্তু এই ৯০ শতাংশের নিচে চাপা পড়ে আছে এক দশকের ভয়াবহ উদাসীনতা ও ব্যর্থতার কাহিনি। ২০১০ সালের পর থেকে গণপরিবহনে নারীর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে হয়রানির ঘটনাও আনুপাতিক হারে বেড়েছে; যদিও প্রতিটি ঘটনা আনুষ্ঠানিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি, তবুও পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালের একটি জরিপে ৯৪ শতাংশ নারীই হয়রানির তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন, যা ২০১৮ সালে ব্র্যাকের আরেক গবেষণাতেও একই চিত্র বহন করেছে। ২০১৯ সালে যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক রিপোর্টে মাত্র এক বছরেই গণপরিবহনে ৫৯ জন নারী ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হন, যা হিমশৈলের চূড়া মাত্র—কারণ সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে ৯৫% ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। ২০২৫ সাল নাগাদ নারীর কর্মক্ষেত্রে বিচরণ যেমন বেড়েছে, তেমনি তাদের উপর সহিংসতার ঝুঁকিও চরম আকার ধারণ করেছে। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তবে ২০৩০ সালের মধ্যে গণপরিবহন দেশের অর্ধেক নাগরিকের জন্য এক অলিখিত 'ভয়ঙ্কর জোন' (Fear Zone)-এ পরিণত হবে, যেখানে নারীর শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসতে পারে। ২০৪০ সাল নাগাদ আমরা দেখব যে শহরগুলোতে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা স্তব্ধ হয়ে গেছে, বিশেষত রাত্রিকালীন কর্মক্ষেত্রে নারীর অনুপস্থিতি প্রকট হয়ে উঠবে, কারণ নিরাপত্তা একটি বিলাসী পণ্য হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি ২০৫০ সালের মধ্যে আমরা উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি, তবে এই সময়েও যদি আমাদের কন্যা মিতুদের গণপরিবহনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি না হয়, তবে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন সূচকে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার এই ব্যর্থতা এক 'চিরস্থায়ী কলঙ্ক' হিসেবে লেখা থাকবে, যা গোটা সমাজকে পিছিয়ে দেবে বহু বছর।

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবারে ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের শেখাতে হবে কীভাবে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাসে বা জনসমাগমপূর্ণ স্থানে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালাতে পারে। পরিবহন শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে তাদের যাত্রীদের প্রতি সম্মান ও দায়িত্ববোধ শেখানো হবে। একটি সুস্থ ও উন্নত সমাজের জন্য এই ধরনের মানবিক উদ্যোগ অপরিহার্য। তবে দুঃখের বিষয় হলো, আমরা প্রায়ই নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলি। যদি সবাই নিজেদের অবস্থান থেকে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে, তবেই সম্ভব একটি নিরাপদ সমাজ গড়া।

গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তাহীনতা একটি গভীর ক্ষত, যা প্রতিনিয়তই আমাদের সমাজকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। এই সমস্যাটি প্রতিরোধে আমরা যথেষ্ট সক্রিয় নই, আর প্রতিকার তো প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ এটি কোনো সমাধানযোগ্য সমস্যা নয়, এটি একটি কঠিন বাস্তবরূপ যার সমাধান সম্ভব। যদি সঠিক এবং সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে এর প্রতিরোধ করা সম্ভব।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করা জরুরি, যা আকস্মিক দুর্ঘটনা মোকাবেলায় সাহায্য করবে। এই রোডম্যাপে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে:

আইনের কঠোর প্রয়োগ: যৌন হয়রানির জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন এবং এর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা।

গণপরিবহনে সিসিটিভি: সব ধরনের গণপরিবহনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা।

আলাদা বগি: বাসে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নয়, বরং আলাদা বগি বা বিশেষ বাস পরিষেবা চালু করা।

সচেতনতামূলক প্রচারণা: পরিবহন শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত প্রচারাভিযান চালানো। এই সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের সবাইকে এক হতে হবে।

ভয় নয়, আজ বিদ্রোহের সুর জাগুক বুকে

নিয়ম নয়, নিরাপত্তা আজ আসুক সমাজের মুখে।

আমাদের বোনেরা আর নয় নিরুপায়,

নিরাপদ পথের দাবি আজ মুক্তির স্লোগান গায়।

লেখক
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব
সহকারী অধ্যাপক
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

দাউদ ইব্রাহিম হাসান
রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ এডভোকেট মো: গোলাম সরোয়ার
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram