কোনো একটি এলাকা সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে চাইলে, তার অতীতের ইতিহাসে ডুব দেওয়া একরকম অনিবার্য। জানতে হয় সেই এলাকার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, এবং স্পর্শ করতে হয় ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকা নিঃশব্দ সাক্ষী স্থাপত্যগুলোকে। ঠিক এই আগ্রহ থেকেই আমরা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাইদের সঙ্গে মানিকগঞ্জ জেলার বিখ্যাত জমিদার বাড়িগুলো ঘুরে দেখার পরিকল্পনা করি। একদিনে আমরা তিনটি ভিন্ন এলকার জমিদারদের রেখে যাওয়া স্থাপত্যেগুলো স্বচক্ষে অবলোকন করি। সেই অভিজ্ঞতা জানাবো আপনাদের।
জমিদারি ব্যবস্থার পটভূমি
জমিদারি ব্যবস্থার সূচনা মুঘল আমলে হলেও এর পূর্ণতা পায় ব্রিটিশ শাসনামলে। মুঘলদের সময় জমিদাররা সরাসরি জমির মালিক না হয়ে ছিলেন প্রভাবশালী কর সংগ্রাহক। তবে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালুর মাধ্যমে তাদের আইনি মালিকানা স্বীকৃতি দেন। জমিদাররা তখন নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব জমা দিয়ে নিজেদের মতো করে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন।
এই ব্যবস্থায় জমিদাররা হয়ে ওঠেন গ্রামের ধনী, ক্ষমতাশালী ও সংস্কৃতির ধারক। তারা কখনো সদয় পৃষ্ঠপোষক, কখনো নিপীড়ক শাসক হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছেন। তবে সময়ের আবর্তনে ১৯৫০ সালে ‘East Bengal State Acquisition and Tenancy Act’ পাস হওয়ার মাধ্যমে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটে।
বাংলাদেশজুড়ে জমিদারদের নির্মিত প্রাসাদ, মঠ, মন্দির ও মসজিদ আজও ইতিহাসের বর্ণময় সাক্ষ্য বহন করে। মানিকগঞ্জ জেলার এমনই তিনটি জমিদার বাড়ি পরিদর্শন করি আমরা।
১. বালিয়াটি জমিদার বাড়ি : রাজকীয় স্থাপত্যের অনুপম নিদর্শন
মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামে অবস্থিত এই প্রাসাদটি উনিশ শতকের রেনেসাঁসধর্মী স্থাপত্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। গোবিন্দ রাম সাহা নামে এক লবণের ব্যবসায়ী এই জমিদার পরিবারের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তীতে তাঁর বংশধরেরা শিক্ষাখাতে অবদান রাখেন, যার মধ্যে অন্যতম কিশোরীলাল রায় চৌধুরী, যিনি জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। যেটা বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নামে সমাদৃত।
প্রায় ৫.৮৮ একর জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই জমিদার বাড়িতে রয়েছে সাতটি বৃহৎ ভবন। বিভিন্ন পরিমাপ ও আকৃতির প্রায় দুই শতাবধি কোঠা রয়েছে।এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ভবনটি বর্তমানে একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত। রাজবাড়ীর ভিতরে রয়েছে একটি পুকুর যার বিশেষত্ব হলো সাতটি ঘাট, যার বর্তমানে ৬ টি অবশিষ্ট রয়েছে একটি নষ্ট হয়ে গেছে।এবং এই পুকুরের সাথে নদীর সংযোগ ছিলো ফলে নিয়মিত জোয়ারভাটা হতো পুকুরে। বিশাল প্রাসাদটির প্রতিটি ব্লকে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ, করিনথিয় স্তম্ভ, সিংহদ্বার ও অন্দরমহল ইতিহাসের সৌন্দর্যকে জীবন্ত করে তোলে।
২. তেওতা জমিদার বাড়ি : প্রেম, প্রতিভা ও পুরাতনের ছাপ
শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন পঞ্চানন সেন। একসময় দরিদ্র এই ব্যক্তি ধীরে ধীরে ধনকুবের হয়ে ওঠেন দিনাজপুরে তামাক ব্যবসার মাধ্যমে এবং প্রতিষ্ঠা করেন জমিদারিত্ব। পরবর্তীতে জয়শংকর ও হেমশংকর নামে দুই ভাই জমিদার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন, যারা দেশভাগের সময় ভারতে চলে যান।
এই বাড়ির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি। এখানেই তিনি প্রমীলা দেবীকে ভালোবাসেন এবং বিখ্যাত কবিতা "তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সেকি মোর অপরাধ" রচনা করেন।
তেওতা জমিদার বাড়ির স্থাপত্যে মুঘল ও ইউরোপীয় রীতির সংমিশ্রণ চোখে পড়ে। প্রায় ৭.৩৮ একর জমির উপর গঠিত এই প্রাসাদে রয়েছে নটমন্দির, নবরত্ন মঠ, ৫৫টি কক্ষবিশিষ্ট ভবন ও একটি বিশাল পুকুর। বর্তমানে বাড়িটির বড় একটি অংশ দখল হয়ে গেছে এবং সংরক্ষণ প্রক্রিয়া কার্যত অনুপস্থিত।
৩. বেতিলা জমিদার বাড়ি : ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষী
বেতিলা জমিদার বাড়িটি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বেতিলা মিতরা ইউনিয়নে অবস্থিত। বাড়িটির নির্দিষ্ট ইতিহাস এখনো স্পষ্ট নয়। লোককথা অনুসারে, এখানে জ্যোতি বাবু নামের এক বণিক ছিলেন যাঁর উত্তরসূরিরা জমিদারি পরিচালনা করতেন। প্রতিষ্ঠাতা জমিদার রামকৃষ্ণ সেন ব্রিটিশ শাসনামলে সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন। বেতিলা জমিদারদের এই প্রজন্ম অনেকে জমিজমা বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছেন আবার অনেকে শহরে অবস্থান করছেন।
বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটি ‘সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এখানেই ‘From Bangladesh’ সিনেমাসহ অনেক নাটক,সিনেমার বড় অংশ চিত্রায়িত হয়।
প্রাসাদে এখনও রয়েছে তাদের ইতিহাস ও স্মৃতির ছাপ, তবে এটি বর্তমানে সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে।
কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ জেলার জমিদার বাড়িগুলো ঘুরে দেখার জন্য আপনি চাইলে ঢাকা,সাভার, মানিকগঞ্জ রুট বেছে নিতে পারেন।
যাত্রা শুরু করার আগে একটু পরিকল্পনা করে নিলে অল্প সময়েই এই তিনটি স্থাপনাই দেখে নেওয়া সম্ভব।
প্রথমে তেওতা জমিদার বাড়ি, বেতিলা জমিদার বাড়ি শেষে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি।
ঢাকা থেকে তেওতা জমিদার বাড়ি, শিবালয় দূরত্ব: প্রায় ৮০ কিমি।
প্রথমে ঢাকা থেকে পাটুরিয়া ঘাট বা আরিচা রুটে শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামে যাওয়া যায়। যাত্রাপথে পদ্মা নদীর আশপাশের দৃশ্য বেশ মনোমুগ্ধকর। পরে তেওতা থেকে বেতিলা জমিদার বাড়ি দূরত্ব: প্রায় ২০ কিমি। শেষে বেতিলা থেকে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি। দূরত্ব: প্রায় ১৫ কিমি
শেষকথা
মানিকগঞ্জের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা এই জমিদার বাড়িগুলো শুধু প্রাচীন স্থাপনা নয় এরা আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমাজগত বিবর্তনের জীবন্ত নিদর্শন। এদের দেয়ালে লেখা রয়েছে প্রজাদের কান্না, জমিদারদের জাঁকজমক, সাহিত্যিক প্রেমের চিহ্ন এবং বাংলার সমাজের এক গৌরবময় অধ্যায়।
এই ভ্রমণ ছিল চোখে দেখা ইতিহাসকে হৃদয়ে ধারণ করার এক অনন্য অভিজ্ঞতা। নতুন প্রজন্মের উচিত এই স্থাপনাগুলোকে চিনে রাখা এবং সংরক্ষণের জন্য সক্রিয় হওয়া। কারণ ইতিহাস শুধু বইয়ে নয়, দালানেও লেখা থাকে।
লেখক
এস এম শাহিন আলম
শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: shahinbillah24@gmail.com