রফিক সজল ভোরের আলোর কিরণে চোখ মেললে বুঝতে পারে—রান্নার অবকাশ নেই। ২০২১ সালে ইসলাম এবং রহমান তাদের গবেষণাপত্রে বলেন যে, অফিসের তাড়াহুড়োয় রাস্তার কোণে পাওয়া প্লাস্টিকের বক্সে রাখা স্যান্ডউইচ ডেকে আনে স্বস্তি, কিন্তু অজান্তেই শুরু হয় অদৃশ্য ক্ষয়। একা দুপুরে ঠোঁটের সঙ্গে মেখে নেওয়া চিজবিরিয়ানি বা ক্রিস্পি ডনাটের ঠাসা স্বাদে শান্তি মেলে, তবে অন্তরে বাজে হৃদপীড়ার নীরব সুর। ২০১৯ সালে আহমেদ এবং রহমান এক জরিপের মাধ্যমে বুঝতে পারেন যে, রক্তচাপের নিয়ন্ত্রণ হারানো, মেজাজের ওঠানামা এবং হঠাৎ করে হতাশায় নিমজ্জনের মতো প্রভাব শরীরের অভ্যন্তরে কাঁটা বোনা শুরু করে । এই গল্প আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, convenience meals অনেকটা সময়ের জঞ্জালে লুকানো দুর্বলতার বীজ বপন করে।
অনেক বিজ্ঞ কালারদের মত আহমেদ এবং করিম ২০২০ সালে তাদের একটি গবেষণা প্রবন্ধেও প্রকাশ করেন এই সমস্যার কথা, ঢাকার কর্পোরেট শহরে অধিকাংশ অফিস কর্মী ৯টা থেকে ৫টার রুটিনে রান্নার সময় না পেয়ে ফাস্টফুড আর প্রি-প্যাকড মিলকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং সিলেটের শহরতলিতে কর্মরত শ্রমিকরাও একই রাস্তা পাড়ি দেয়, কারণ রান্নার সুবিধার অসমতা প্রবল। ২০১৯ সালে চৌধুরী এবং তালুকদার এক জার্নালে বলেছেন যে, শহরের স্লাম এলাকায় থাকা দরিদ্র পরিবারগুলোও রাতে convenience meals-এ নির্ভর করে, কারণ রান্নার কাঠ পোড়ার খরচ সামলানো কঠিন। এ অবস্থায় শহরের লাক্সারি হোটেল থেকে শুরু করে সস্তা স্ট্রিট ফুড—প্রত্যেকটি প্যাকেটেই লুকিয়ে আছে স্বাস্থ্যঝুঁকির বীজ, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ফাটল আরও বিস্তার করে।
ব্যস্ত জীবনে জাঙ্ক ফুড বা নিম্নমানের খাবারের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বহুমাত্রিক।
উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ: ২০২২ সালে হোসেন হাসান এবং জামান তাদের গবেষণা ক্ষেত্রে ফুটিয়ে তোলেন এই বিষয়গুলো অতিরিক্ত সোডিয়াম উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে, যা কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ঝুঁকি দ্বিগুণ করে। রাজধানীর কল সেন্টারে কাজ করা রুমী বলছেন, “আমি দিনে তিনবার convenience meals খাই, আর এখন আমার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে”।
লিভার ও মেদ বৃদ্ধি: চৌধুরী ও তালুকদার ২০১৯ সালে ব্যাপক আলোচনা করেন তাদের গবেষণাপত্রে এই বিষয়ে, ট্রান্সফ্যাট লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ভালো কোলেস্টেরল কমিয়ে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ায়।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: বিশ্বের স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৮ সালে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যেখানে তারা বলেন যে, অতিরিক্ত চিনি ও সংরক্ষক উপাদান উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং অনিদ্রা তৈরি করে, যা স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অবসাদমুখী মেটাবলিক সিনড্রোম: ওবেসিটি, ইনসুলিন রেজিস্টেন্স এবং দীর্ঘমেয়াদী স্থূলতার ঝুঁকি বাড়িয়ে এমন ‘নীরব মহামারী’ গড়ে তোলে, যার বিস্তার রোধের মাপকাঠি এখনও নির্মিত হয়নি।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতায় স্বাস্থ্য, ঘুম এবং মানসিক পুনর্গঠনের সংকট নিয়ে তার কিছু কবিতায় মানসিক অবসাদ, ক্লান্তি এবং সমাজের অসাম্য নিয়ে গভীর প্রতিফলন রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তার "ইশতেহার" কবিতায় তিনি লেখেন:
"আজ আমরা আবার সেই
স্বাস্থ্য আর শরীরের লাবন্যকে ফিরে পেতে চাই।
আজ আমরা আবার সেই
কান্নাহীন আর দীর্ঘশ্বাসহীন জীবনের কাছে যেতে চাই।"
যদি আমরা আজই সচেতন হই না, ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছেন যে আগামী দশকে বাংলাদেশে নন-কমিউনিকেবল ডিজিজজনিত মৃত্যুহার আনুমানিক ২৫% বৃদ্ধি পাবে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে ৩–৫% ক্ষতির কারণ হবে। ২০২২ সালে হোসেন এবং অন্যান্য কলেজরা তাদের গবেষণা পত্রে লিখেছিলেন যে চিকিৎসা খরচ বাড়লে দরিদ্র পরিবার আর্থিকভাবে ভেঙে পড়বে; ২০২০ সালে নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের চিকিৎসায় মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ২০% ব্যয় হয়েছে। শারীরিক দুর্বলতা ও মনোযোগহীনতায় শিক্ষার্থীরাই পিছিয়ে যাবে, যা ভবিষ্যতের নেতৃত্ব ও মানবসম্পদকে দুর্বল করে দেবে। এই সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি সামাজিক সম্প্রীতাকেও অটল করবে না, আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বপ্নকে সাবেকি করে তুলবে।
২০০৩ সালে ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের “গ্রামীণ ড্যানন” উদ্যোগে প্রবর্তিত পুষ্টিমানসমৃদ্ধ দই (Shokti Doi) গ্রামে সহজলভ্য হয়েছে, স্বল্পমূল্যে পুষ্টি নিশ্চিত করেছে । তিনি “গ্রামীণ ফুড পার্ক” প্রতিষ্ঠা করে কৃষকদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার উৎপাদন ও বিপণনে সহায়তা দেন। সাম্প্রতিক “শোভন কমিউনিটি কিচেন” প্রকল্পে দরিদ্র পরিবারগুলোকে সুষম খাবার সরবরাহ করে সামাজিক সম্প্রীতি এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি হয়েছে। এর পাশাপাশি ‘গ্রামীণ পুষ্টি সেল’ চালু করে পুষ্টি প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা ocre করেছে, যা খাদ্যাভ্যাসের অজানা ক্ষয় প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ব্যস্ত জীবনে convenience meals নীরব ক্ষয় বয়ে আনে, যা ব্যক্তিগত ও জাতীয় অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। তবে স্বাস্থ্যশিক্ষা, সামাজিক উদ্ভাবন ও নীতি-প্রণয়নের সমন্বয়ে এ ক্ষয় প্রতিরোধ করা সম্ভব। সরকার, বেসরকারি খাত ও কমিউনিটি একযোগে কাজ করলে সুস্থ খাদ্যাভ্যাস ফিরিয়ে এনে বিরামহীন অগ্রগতি নিশ্চিত করা যাবে। “স্বাস্থ্যকর খাবার জীবনের আলোর চাবিকাঠি—একবার জ্বলে উঠলেই সব অন্ধকার বিদায় নেয়।”
লেখক
ড: তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব
সহকারী অধ্যাপক
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপ
দাউদ ইব্রাহিম হাসান
রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়