ঢাকার অন্ধকার নীরবতায় একা বসে থাকলে মনে হয়, শহরের আলো-আঁধারির খেলা যেন হৃদয়ের মেঝেতে নেমেছে আর সেখানে গোপন এক ক্লান্তির দাবানল জ্বলছে। রহমান এবং খান ২০২০ সালে তাদের এক সমীক্ষায় তুলে ধরেন এই শহরের ভয়ংকর এক অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায় যেখানে নিশিশব্দ ভাঙে কর্কশ ট্রাফিকের হর্নে, পেট্রোল পাম্প থেকে উঠে আসা গ্যাসের ফিসফিসানিতে, আর রান্নার চুলায় ধোঁয়া জমে ওঠা কণ্ঠস্বরের মাঝে—সব মিশে এক জ্বলন্ত চাপ তৈরি করে। মুনিয়ার চোখে জম থাকে দিনের পরিশ্রমের ছাপ, রাতে কিন্তু স্বপ্ন আসে না; তার নিদ্রা ভাঙে বারবার, যেন প্রতি মুহূর্তে ভাঙা ফাঁসানো স্বপ্নে সে হারিয়ে যায়। এ ক্লান্তি যদি সংগৃহীত হত, তবে এখনই সময় সচেতন হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার।
২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে পটুয়াখালীর এক প্রাইমারী স্কুলের গল্প যেখানে বিকেলবেলা শিশুরা বলছে, রাতের ঝড় গুঁড়িগুঁড়ি শব্দ তাদের নিদ্রাকে অজান্তেই ভাঙে। ডার্মার ও ডিঙ্গেস ২০০৫ সালে লক্ষ্য করেছিলেন, ঢাকার রাস্তায় ভোরবেলা রিকশাচালকরা যানজটে আটকে থেকে শরীরে ক্লান্তির ছাপ নিয়ে দিন শুরু করেন। একই সময়ে গৃহিণীরা রান্নাঘরের ধোঁয়ায় চোখে জ্বালা নিয়ে কাজ শুরু করেন, যেখানে ভোরের নরম আলোও কোনো প্রশান্তি এনে দিতে পারে না। নিরানন্দ পরিবেশে কাজ করলে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা কমে যায়, এবং পরিবারের আর্থিক দুরাবস্থা ক্রমশ বাড়ে। এ বাস্তবতা প্রমাণ করে যে আনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব একসঙ্গে ঘুমের ভাঙা চাকা গড়ে তোলে।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় শব্দদূষণ, ঘুমবিচ্ছিন্নতা ও মানসিক পুনর্নির্মাণের সংকট সরাসরি আলোচিত না হলেও, তাঁর রচনায় নগরজীবনের যান্ত্রিকতা, সামাজিক বৈষম্য এবং সাধারণ মানুষের ক্লান্তি ও হতাশা গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতা 'ঘুম নেই' (১৯৫৪) শারীরিক ও মানসিক অবসাদের চিত্র তুলে ধরে, যা ঘুমহীনতা ও মানসিক ক্লান্তির প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। এছাড়া, 'ছাড়পত্র' কবিতায় তিনি লেখেন:
“আঠারো বছর বয়সেই অহরহ,
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।”
বনেট এবং অরান্ড ২০০৩ সালে খেয়াল করে দেখেন যে, ঘুমের মাঝখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সময়ে ভাঙা হলে মস্তিষ্কের পুনর্নির্মাণ ব্যাহত হয়; নিউরোপ্লাস্টিসিটি নীরব নাহাক্যে পড়ে যায়, যা স্মৃতি সংকোচন ও শিক্ষণের সমস্যা সৃষ্টি করে। মালহোত্রা এবং ফিচের ২০১৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কার্যকারিতা কমে গেলে সমালোচনামূলক চিন্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফোনের নোটিফিকেশন, উচ্চ শব্দদূষণ ও অপ্রতুল আলো নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ঘুমের মান আরও খারাপ হয়ে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বাড়ায়। নিয়মিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাজনের ফলে দীর্ঘমেয়াদে দেখা দেয় স্নায়ুবিক যন্ত্রণা, যা চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা বাড়িয়ে দেয় এবং জীবনমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
যদি আমরা এক্ষুনি পদক্ষেপ না নেই, দশ বছরের মধ্যে উচ্চ মাত্রার ঘুমবিচ্ছিন্নতা মানসিক রোগীর সংখ্যা ৩০% বৃদ্ধি করতে পারে, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে ১০%-১৫% যা ডার্মার ও ডিঙ্গেস এর গবেষণায় প্রতিফলিত হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে অনুপস্থিতির হার বাড়বে, মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে, আর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় প্রবীণদের হার বাড়বে। জাতীয় অর্থনীতির জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় ৩%-৪% এবং সামাজিক সংহতি দুর্বল হয়ে যাবে। SDG (সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) এর লক্ষ্যমাত্রায় অগ্রগতি বিলম্বিত হবে, কারণ ঘুমের খন্ডন সমাজের প্রতিটি স্তরে আঘাত করে সামষ্টিক উন্নয়ন।
২০২৩ সালে ডাঃ মুহাম্মদ ইউনূসের ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ এবং ‘গ্রামীণ শাক্তি’ উদ্যোগে উদ্ভাবিত মাইক্রো-ঋণ প্রকল্পে প্রথম বছরে ২০ হাজার নারী উদ্যোক্তা পেয়েছিল আর্থিক নিরাপত্তা, যা তাদের মানসিক শান্তি ও ঘুমের মান উভয়ই বাড়িয়েছে। ঋণের সাথে সংযুক্ত স্বাস্থ্যবিধি সেশন এবং সামাজিক কর্মশালায় তারা শিখেছে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ও ঘুমচক্র পুনর্সংগঠনের কৌশল। এ উদাহরণ প্রমাণ করে, অর্থনৈতিক সংহতি মানসিক সুস্থতা ও শান্তির মাধ্যমে স্বপ্নের বিশ্রাম ফিরিয়ে আনতে পারে।
এ অদৃশ্য ক্লান্তি আমাদের স্বাধীনতার পথে অনবরত বাধা দেয়। তবুও, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা, আর সামাজিক আর্থিক সহযোগিতার সমন্বয়ে আমরা এটিকে পরাজিত করতে পারি, যা ২০২০ সালের রহমান এবং খান তাদের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন। প্রয়োজন আছে গবেষণামূলক স্বাস্থ্য-ইনোভেশন, স্থানীয় কমিউনিটি গার্ডেন, এবং প্রতিটি গ্রামে নিয়মিত মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা গ্রুপ। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ, প্রাত্যহিক মেডিটেশন প্র্যাকটিস এবং পারিবারিক সহায়ক একে অপরকে মনোনিবেশের নিরাপদ উৎস হিসেবে গড়ে তোলা। এ ক্লান্তি মোকাবেলা করে আমরা অর্জন করব স্বাস্থসম্মত সমাজ এবং সক্রিয় জাতীয় অগ্রগতি।এই যাত্রায় আমাদের প্রত্যেকের সচেতনতা ও সহযোগিতা জরুরি। প্রতিদিন বুঝে শুনে বিশ্রাম নিলে ঘুম ভাঙার অদৃশ্য ক্লান্তি মোকাবেলা করা সম্ভব। “যখন স্বপ্ন চরিতার্থ হয় গভীর ঘুমে, তখনই নীরব ক্লান্তি হার মানে।”
লেখক
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব
সহকারী অধ্যাপক
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
দাউদ ইব্রাহিম হাসান
রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়