ভোর ফুরিয়ে সূর্য যখন তার সোনালি আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল, তখনো কুমিল্লার মুলান্দা-আমিরাবাদ সড়ক জানতো না যে, তার বুকে এক গভীর ক্ষত তৈরি হতে চলেছে। ২২শে আগস্ট, ২০২৫, সকালের বাতাস যখন নির্মলতা নিয়ে আসছিল, ঠিক সেই সময়ে একটি দ্রুতগামী কাভার্ড ভ্যান তার দানবীয় শক্তিতে গুঁড়িয়ে দেয় একটি নিরীহ অটোরিকশাকে। পীতুজ মন্ডল, জাহানারা বেগম, তার ছেলে শফিউল্লাহ, মনির হোসেন এবং ইসমাইল হোসেন—পাঁচটি প্রাণ মুহূর্তেই নিভে গেল, যেন এক নিমেষের ভুলে সব রঙ মুছে গেল জীবনের ক্যানভাস থেকে। তাদের মৃত্যু কেবল কিছু নাম বা সংখ্যার হিসাব নয়, এটি ছিল অসংখ্য পরিবারের স্বপ্ন, হাসি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অপমৃত্যু। জাহানারা বেগম হয়তো তার সন্তানের জন্য দুপুরে খাবার তৈরি করার কথা ভাবছিলেন, শফিউল্লাহ হয়তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন, আর মনির হোসেন বা ইসমাইল হোসেন হয়তো তাদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ছুটে চলেছিলেন। এই দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, রাস্তাগুলো এখন আর কেবল যাতায়াতের পথ নয়, বরং এক অজানা আতঙ্কের প্রতীক। এই দুর্ঘটনা সমাজের গভীর ক্ষতকে তুলে ধরেছে—যেখানে প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও, জীবনের নিরাপত্তা এখনও এক অবহেলিত অধ্যায়।
প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে কেবল একটি কারণ থাকে না, থাকে একটি বহুস্তরীয় জটিল জালের বুনন। কুমিল্লার এই ঘটনাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রশ্ন জাগে, উন্নত সড়ক, আধুনিক যানবাহন থাকা সত্ত্বেও কেন এই ভয়াল মৃত্যুর মিছিল? মূল সমস্যাটি কি শুধু চালকের বেপরোয়া গতি, নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে আরও অনেক কিছু? চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব, লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে দুর্নীতি, এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার ফলে মানসিক ও শারীরিক অবসাদ —এগুলো সবই দুর্ঘটনার কারণ। কিন্তু এর বাইরেও আরেকটি দিক রয়েছে যা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। সেটি হলো যানবাহনগুলোর দুর্বল যান্ত্রিক অবস্থা। অনেক সময় ত্রুটিপূর্ণ ব্রেক, পুরনো টায়ার বা অন্যান্য যান্ত্রিক সমস্যাও দুর্ঘটনার জন্ম দেয়। সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI)-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৪০% দুর্ঘটনার পেছনেই যান্ত্রিক ত্রুটি একটি বড় কারণ। এর পাশাপাশি, সরকারের দুর্বল নজরদারি এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবও এই মৃত্যুমুখীন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে বাড়ি ফেরার প্রত্যাশা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। জীবন যেন এক অনিশ্চিত খেলায় পরিণত হয়েছে, যেখানে যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যুর যমদূত বিনা প্রস্তুতিতে কেড়ে নিতে পারে সবকিছু। সরকার এবং প্রশাসনের দায়িত্ব শুধু আইন প্রণয়ন করা নয়, বরং সেই আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা। বেপরোয়া ড্রাইভিং, ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং অদক্ষ চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই করুণ চিত্র কোনোদিনও বদলাবে না।
যদি এই সমস্যাটির সমাধান না হয়, তবে এর ভয়াবহতা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে। আজকের যে পাঁচটি প্রাণ ঝরে গেল, কাল হয়তো তা শত বা হাজারে রূপ নেবে। একটি দুর্ঘটনা কেবল একটি পরিবারের জীবনকে ধ্বংস করে না, বরং দেশের অর্থনীতি, সামাজিক কাঠামো এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একজন উপার্জনকারী সদস্যের মৃত্যু একটি পরিবারকে আর্থিক সংকটে ফেলে দেয়, যা দারিদ্র্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। শিশুদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়, অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসার অভাব দেখা দেয়। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক আঘাতের কারণে বেঁচে থাকা মানুষেরা হতাশা ও উদ্বেগের শিকার হয়। এই ট্র্যাজেডিগুলো পুরো সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করে ফেলে। একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হলে এই নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে এখনই রুখে দাঁড়ানো উচিত। যদি এই সংকট সমাধান না হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেখবে এক ভঙ্গুর সমাজ, যেখানে জীবনের কোনো মূল্য নেই।
পরিবর্তনের বীজ রোপণ করতে হলে সাধারণ মানুষ এবং তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা কেবল সচেতনতামূলক পোস্টার বা র্যালি করে ক্ষান্ত থাকলে হবে না, বরং তাদের বাস্তব জীবনে ট্রাফিক আইন মেনে চলার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, তরুণরা বেপরোয়াভাবে বাইক চালিয়ে নিজেদের এবং অন্যদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে। কিন্তু পরিবর্তনের চিত্রটি অন্যরকম হতে পারে। বর্তমানে অনেক তরুণ স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে স্থানীয়ভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারা পথচারীদের নিরাপদ রাস্তা পারাপার সম্পর্কে শেখাচ্ছে, চালকদেরকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে উৎসাহিত করছে এবং দুর্ঘটনার শিকার হওয়া পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এই ধরণের উদ্যোগ ভবিষ্যতে সমাজের চালচিত্র বদলে দিতে পারে। পাশাপাশি, সরকার এবং প্রশাসনিক সংস্থাগুলোর উচিত কেবল শহরকেন্দ্রিক সচেতনতা নয়, বরং গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এর কার্যক্রম বিস্তার করা। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম, গণমাধ্যম এবং স্থানীয় সংগঠনের মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে, যা সহজে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে। শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই নয়, বরং সাধারণ মানুষের মাঝে নৈতিকতা এবং দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার মাধ্যমেই এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সম্ভব। আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত রোডম্যাপ যেখানে সরকার, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণ একসাথে কাজ করবে, যাতে করে প্রতিটি মানুষ তার জীবন নিয়ে ঘরে ফিরতে পারে।
কুমিল্লার এই বেদনাদায়ক ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের অবহেলা, দুর্নীতি এবং দায়িত্বহীনতার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। এই 'অতল পাপ' আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, জীবনের মূল্য কতটা তুচ্ছ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, এই সমস্যার কোনো সমাধান নেই। প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সদিচ্ছা এবং কঠোর পদক্ষেপ। সরকার এবং প্রশাসনকে সড়ক নিরাপত্তা আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে, দুর্নীতিমুক্ত লাইসেন্স প্রদান নিশ্চিত করতে হবে এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসাথে, ব্যক্তি পর্যায়ে আমাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। ট্রাফিক আইন মেনে চলা, হেলমেট ব্যবহার করা, এবং বেপরোয়া গতি পরিহার করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই সংকট মোকাবিলায় আমাদের একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে, যেখানে দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত করে তার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খুঁজে বের করা হবে। কেবল তখনই আমরা একটি নিরাপদ সমাজের স্বপ্ন দেখতে পারি, যেখানে প্রতিটি জীবন মূল্যবান এবং প্রতিটি যাত্রা নিরাপদ।
কতকাল আর এভাবেই পথে-ঘাটে লাশের স্তূপ জমবে? কতকাল আর আমাদের স্বপ্নগুলো এভাবে শেষ হয়ে যাবে একটি কাভার্ড ভ্যানের নিচে? আর নয়! আমাদের চুপ করে থাকার সময় শেষ। এখন সময় এসেছে প্রতিবাদের, প্রতিরোধের। প্রতিটি জীবন মূল্যবান—এই স্লোগানকে বুকে ধারণ করে আমরা রুখে দাঁড়াব, যতক্ষণ না প্রতিটি রাস্তা নিরাপদ হয়, যতক্ষণ না প্রতিটি জীবনের মূল্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা একটি নিরাপদ পৃথিবী উপহার দেব, যেখানে মৃত্যু নয়, জীবনই হবে একমাত্র সত্য!
লেখক
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব
সহকারী অধ্যাপক
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
দাউদ ইব্রাহিম হাসান
রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়