ঢাকা
২৬শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
ভোর ৫:২০
logo
প্রকাশিত : এপ্রিল ১০, ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ, বিশ্ব অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৯ এপ্রিল থেকে চীনা পণ্য আমদানির উপর ১০০ শতাংশরও বেশি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। এর জবাবে সব ধরনের মার্কিন পণ্যে ৮৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে চীনের অর্থ মন্ত্রণালয়।

দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান এই ‘বাণিজ্য সংঘাত’ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বেশ গুরুত্ব বহন করে এই দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে গত বছর, সব মিলিয়ে প্রায় ৫৮৫ বিলিয়ন ডলার (৫৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার) মূল্যের পণ্য বাণিজ্য হয়েছে।

যদিও চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে তার তুলনায়, চীন থেকে অনেক বেশি পরিমাণে পণ্য আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হিসাব অনুযায়ী, গত বছর চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হয়েছে ৪৪০ বিলিয়ন ডলার (৪৪ হাজার কোটি ডলার) মূল্যের বাণিজ্য পণ্য আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন আমদানি করেছে ১৪৫ বিলিয়ন ডলার (১৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার) মূল্যের পণ্য।

এর ফলে ২০২৪ সালে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২৯৫ বিলিয়ন ডলার (২৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলার)। এই ঘাটতি বেশ উল্লেখযোগ্য এবং এর পরিমাণ তবে মার্কিন অর্থনীতির প্রায় এক শতাংশের সমান।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চলতি সপ্তাহে এই বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ডলার (এক লাখ কোটি ডলার) বলে বারবার দাবি করলেও বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কিন্তু তার চাইতে কমই।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদেই চীনের উপর বড় ধরনের শুল্ক আরোপ করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরে ট্রাম্পের উত্তরসূরি তথা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময়ও এটি বহাল থাকে। এই সব ‘ট্রেড ব্যারিয়ার’ অর্থাৎ বাণিজ্য বাধা চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মোট আমদানির পরিমাণ কমিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালে মোট আমদানির পরিমাণ ২১ শতাংশ কিন্তু ২০২৪ সালে তা কমে ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। তাই গত এক দশকে বাণিজ্যের দিক থেকে চীনের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা কিছুটা কমেছে।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু চীনা পণ্য রপ্তানি পুনঃপ্রবাহিত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মাধ্যমে।

উদাহরণ স্বরূপ সৌর প্যানেল। ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৮ সালে চীন থেকে আমদানি করা সৌর প্যানেলের উপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি।

চীনা সৌর প্যানেল প্রস্তুতকারকরা তাদের ‘অ্যাসেম্বলি অপারেশনস’ স্থানান্তরিত করে দেয় মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামের মতো বিভিন্ন দেশে এবং তারপর চূড়ান্ত পণ্য ওই সমস্ত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো শুরু করে।

এর ফলে, চীন তাদের উপর আরোপ করা শুল্ক এড়িয়ে ঘুরপথে ওই সমস্ত দেশগুলো থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে সৌর প্যানেলগুলো রপ্তানি করতে থাকে।

এই ঘটনার স্বপক্ষে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালে প্রমাণও দিয়েছে।

বর্তমান আবহে ওই দেশগুলোর উপর রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। এর ফলে বাস্তবে চীনা পণ্য যা ঘুরপথে ওই সমস্ত দেশ হয়ে আসছিল, তার মূল্য মার্কিন বাজারে বেড়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনে গত বছর যে সমস্ত পণ্য রফতানি হয়েছে, তার সবচেয়ে বড় অংশ ছিল সয়াবিন। চীনের আনুমানিক ৪৪০ মিলিয়ন (৪৪ কোটি) শূকরকে খাওয়ানোর জন্য মূলত ব্যবহার করা হয় ওই সয়াবিন।

এ ছাড়া, চীনে ওষুধ ও পেট্রোলিয়ামও পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, চীন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর পরিমাণে ইলেকট্রনিক্স আইটেম, কম্পিউটার এবং খেলনা রপ্তানি করা হয়েছিল। বিপুল পরিমাণ ব্যাটারিও রপ্তানি করা হয়েছিল। বৈদ্যুতিক যানবাহনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ওই ব্যাটারি।

প্রসঙ্গত, চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যের বৃহত্তম অংশ হলো স্মার্টফোন। এর পরিমাণ মোট আমদানির নয় শতাংশ। এই সমস্ত স্মার্টফোনের একটা বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের জন্য চীনে তৈরি করা হয়।

ইতোমধ্যে, গত মাসে অ্যাপলের শেয়ারের দাম ২০ শতাংশ পড়ে গিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন বেইজিংয়ের উপর শুল্ক আরোপ করার কারণে চীন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হওয়া এই সমস্ত পণ্য মার্কিন নাগরিকদের জন্য যথেষ্ট ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে চলেছে।

এখন চীন থেকে আসা সমস্ত পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক ১০০ শতাংশের বেশি করায় দামে তীব্র প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, চীনের 'প্রতিশোধমূলক শুল্ক নীতির' কারণে চীনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। এর ফলস্বরূপ মার্কিন উপভোক্তাদের মতো চীনা ভোক্তারাও একইভাবে ক্ষতির মুখে পড়বেন।

তবে শুল্কের বাইরেও এই দুই দেশের বাণিজ্যের মাধ্যমে একে অপরের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে এবং তার জন্য অন্যান্য উপায় রয়েছে বৈকি।

শিল্পের নিরিখে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধাতু পরিশোধনের ক্ষেত্রে চীনের কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। এই তালিকায় তামা এবং লিথিয়াম থেকে শুরু করে বিরল উপাদান রয়েছে।

এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাতু যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বেইজিং। জার্মেনিয়াম এবং গ্যালিয়াম আমদানির ক্ষেত্রে এই জাতীয় বাধা তৈরির মতো পদক্ষেপ অবশ্য ওই দেশকে আগেও নিতে দেখা গিয়েছে। মার্কিন সামরিক বাহিনী ব্যবহৃত র‍্যাডার এবং থার্মাল ইমেজিংয়ের জন্য জার্মেনিয়াম এবং গ্যালিয়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে চীনের উপর প্রযুক্তিগত বাধা আরও কঠোর আকার ধারণ করতে পারে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে এই জাতীয় প্রযুক্তিগত বাধা আরোপ করা হয়েছিল। এর ফলে চীনের পক্ষে মার্কিন দেশ থেকে উন্নত মাইক্রোচিপ আমদানি করা কঠিন হয়ে পড়ে।

এআই অ্যাপ্লিকেশনগুলোর (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন) জন্য এই জাতীয় অত্যাধুনিক মাইক্রোচিপ অত্যাবশ্যক। কারণ এটা এখনও পর্যন্ত তারা নিজেরা উৎপাদন করতে পারে না।

এ দিকে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো চলতি সপ্তাহে জানিয়েছেন কম্বোডিয়া, মেক্সিকো ও ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশগুলো যদি মার্কিন দেশে তাদের পণ্য রফতানি অব্যাহত রাখতে চায়, তাহলে তাদের চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক না রাখার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

অন্যান্য দেশকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে?

ইন্টারন্যাশানাল মানিটরি ফান্ড (আইএমএফ) বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৪৩ শতাংশই দখল করে রয়েছে দুই দেশ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।

যদি তারা 'অল-আউট ট্রেড ওয়ার'-এ (সর্বাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধে) জড়িয়ে পড়ে এবং সেটা তাদের প্রবৃদ্ধিকে ধীর করে দেয় বা দুই দেশকে আর্থিক মন্দার কবলে পড়ার দিকে ঠেলে দেয় তাহলে তার প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পড়তে পারে। কারণ এর প্রভাব সম্ভাব্য ধীর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির আকারে অন্যান্য দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বৈশ্বিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়াও এর একাধিক সম্ভাব্য প্রভাব থাকতে পারে।

চীন বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদনকারী দেশ। সে দেশের উৎপাদনের পরিমাণ সেখানকার নাগরিকরা যা ভোগ করেন তার চাইতে বেশি। চীনের তরফে ইতিমধ্যে প্রায় এক লাখ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। এর অর্থ হলো, চীন বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানির চাইতে বেশি পণ্য রপ্তানি করছে।

দেশীয় ভর্তুকি এবং অনুকূল সংস্থাগুলোর জন্য সস্তায় ঋণের মতো রাষ্ট্রীয় আর্থিক সহায়তার কারণে চীনে অনেক কম মূল্যে উৎপাদন সম্ভব হয়। যেমন এক্ষেত্রে ইস্পাত একটা উদাহরণ।

এখন একটা ঝুঁকি থেকে যায় যে চীন যদি এই জাতীয় পণ্যগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে না প্রবেশ করাতে পারে তাহলে চীনা সংস্থাগুলো ওই পণ্য বিদেশে ‘ডাম্প’ করার চেষ্টা করতে পারে।

কিছু উপভোক্তাদের জন্য এটা উপকারী হতে পারে কিন্তু এই জাতীয় পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে যে উৎপাদকরা রয়েছে তাদের উপর প্রভাব ফেলবে। ওই দেশে চাকরি এবং মজুরির ক্ষেত্রে তা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

লবি গ্রুপ ‘ইউকে স্টিল’ ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের বাজারে অতিরিক্ত ইস্পাত পুনঃনির্দেশিত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে।

চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব কিন্তু বিশ্বব্যপী দেখা যেতে পারে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সিংহভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন এই প্রভাব কিন্তু অত্যন্ত নেতিবাচক হবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram