মাঈন উদ্দিন সরকার রয়েল, কেন্দুয়া (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি: নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আমতলা রোয়াইলবাড়ী ইউনিয়নে কালের সাক্ষী হয়ে আছে বাংলার প্রাচীন শাসন কর্তাদের নির্মিত ঐতিহাসিক নিদর্শন রোয়াইলবাড়ি দুর্গ। এই পুরাকীর্তিকে ঘিরে রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। ইতিহাসবিদদের ধারণা, দুর্গটি মোগল আমল অথবা সুলতানী আমলের কোনো সেনানায়কের আমলে নির্মিত হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন এ স্থাপত্যটিকে কেন্দ্র করে এলাকায় প্রচলিত রয়েছে নানান জনশ্রুতি।
প্রাচীন ইতিহাস জানতে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইল বাড়ি আমতলা ইউনিয়নের রোয়াইল বাড়ি এলাকায় অবস্থিত এ দুর্গটিতে প্রতিদিনই ছুটে আসছেন পর্যটকরা। সরকারিভাবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে ঐতিহাসিক এসব নির্দশন সংরক্ষণের জন্য মাঝে মধ্যে খনন কাজ শুরু হলেও মাঝ পথে আবার থেমে যায়। সরকার নজর দিলে ঐতিহাসিক দুর্গটি হতে পারে একটি চমৎকার পর্যটন কেন্দ্র। এখানে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এ এলাকাটি একটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠার প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা হয়ে উঠছে না। এতে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব আয় থেকেও।
কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিম দিকে অবস্থিত ঐতিহাসিক রোয়াইবাড়ি দুর্গ। কালের আবর্তে এ দুর্গটি হারিয়ে যায় মাটির নিচে। এরপর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে সরকারিভাবে ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষায় প্রায় ৪৬ একর ভূমি পুর্রার্কীতি এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সে সময় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শুধুমাত্র একটি সাইন বোর্ড টানিয়ে দিয়ে এলাকাটিকে একটি সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করলেও নির্মাণ করা হয়নি কোনো বাউন্ডারী দেয়াল কিংবা কাঁটা তারের বেড়া। একপর্যায়ে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দুর্গটিতে খনন কাজ চালায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। খনন কাজ পরিচালনা করে দুর্গটির সন্ধান পাওয়া যায়। সে সময় মাটির ঢিবি খনন করে সন্ধান পাওয়া যায় কারুকার্য সংবলিত ইট দিয়ে গড়া একটি বারো দুয়ারি মসজিদ এবং এর আশেপাশে প্রাসাদের চিহ্ন, একটি সুড়ঙ্গ পথ। সুড়ঙ্গের পাশেই একটি বটগাছের নিচে কথিত নিয়ামত বিবির মাজার এবং প্রায় ১২ হাত লম্বা ডেংগু মালের কবরস্থান। তখন খনন কাজ সমাপ্ত করার পর থেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে পাথরের ও কাঁচের বিভিন্ন পিলার।
এদিকে সর্বশেষ ২০১৭ সালে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নতুন করে খনন কাজ শুরু করে আরও বেশ কিছু ঐতিহাসিক নির্দশন বারো দুয়ারি মসজিদের দক্ষিণ দিকে খুঁজে পায়। খুঁজে পায় দুর্গের ফটকের সন্ধান। খনন করে সংরক্ষিত বিভিন্ন কারুকার্য সংবলিত ইট পাথরের অস্থায়ী প্রদর্শনী উপস্থাপন করা হয় সেখানে। এ প্রদর্শনী ও খনন কাজ দেখতে পরিদর্শনে যান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তৎকালীন মহা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আলতাব হোসেন। তিনি পরিদর্শনকালে স্থানীয় এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে এলাকাটিকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আশ্বাস দিলেও খনন কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কয়েক বছরেরও তার কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এদিকে ঐতিাহসিক রোয়াইলবাড়ী দুর্গ এলাকা দেখতে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা এখানে আসছেন। কিন্তু সম্ভাবনাময় এ পর্যটন এলাকাটিতে জেলা পরিষদের উদ্যোগে পাকা করে দুটি ছাতাকৃতির বিশ্রামাগার নির্মাণ করলেও এর আধুনিকায়নে আর কিছুই করা হয়নি। এ এলাকাটি এলাকাটি খুবই সুন্দর। দুর্গের স্থাপনাগুলোও বেশ দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু নেই কোনো রেস্টুরেন্ট বা বিশ্রামাগারও। দুর্গটির উন্নয়ন কাজ করা হলে এবং পর্যটকদের জন্য সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হলে এখানে দর্শনার্থীদের যাতায়াত আরো বৃদ্ধি পাবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমদাদুল হক তালুকদারের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, দুর্গটির সৌন্দর্য ও পর্যটকদের সুবিধা বৃদ্ধিসহ পুরো দুর্গ এলাকার উন্নয়নে একটি পরিকল্পনা ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করি সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এটি জেলার একটি অন্যতম পর্যটক এলাকা হিসাবে গড়ে উঠবে।
এ বিষয়ে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস জানান, যদি অধিদপ্তর-মন্ত্রণালয় থেকে খনন কাজের জন্য আবারও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাওয়া যায় তবে রোয়াইল বাড়ি দুর্গসহ জেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। এরইমধ্যে এ বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক দলিলপত্র অনুযায়ী রোয়াইলবাড়ি দুর্গের ইতিহাস সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ‘রোয়াইলবাড়ি’ শব্দটি আরবী ও বাংলা শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘রোয়াইল’ শব্দটি এসেছে আরবী ‘রেইল’ বা ‘রালাহ’ শব্দ থেকে- যার বাংলা অর্থ ‘অশ্বারোহী সৈন্যদল’। আর বাংলায় ‘বাড়ি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘ঘর’ বা ‘বসবাসের জায়গা’। তাই বাংলায় ‘রোয়াইলবাড়ি’ শব্দের পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায়- ‘অশ্বারোহী সৈন্যদলের বাড়ি’। এলাকার লোকজন এ পুরাকীর্তিটিকে ‘ঈশাখার দুর্গ’ হিসেবে জানেন।
স্থানীয় ঐতিহাসিকের মতে, ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্ কামরূপের রাজা নিলাম্বরের বিরুদ্ধে প্রচুর- যুদ্ধ পরিচালনা করে কামরূপ রাজ্য অধিকার করেন। পরে তার পুত্র নছরৎ শাহ্ কামরূপ রাজ্য শাসন করেন। এর কিছুদিন পর তিনি প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখে বিতাড়িত হন এবং কামরূপ থেকে পালিয়ে এসে রোয়াইলবাড়িতে আশ্রয় নেন। তখন তিনি এ অঞ্চলটির নামকরণ করেন ‘নছরৎ ও জিয়াল’ (কারও কারও মতে- ‘নছরৎ আজিয়াল’)। পরবর্তীতে তার শাসনান্তর্গত সমস্ত প্রদেশটিই ‘নছরৎশাহী পরগনা’ নামে পরিচিত হয় এবং আকবর শাহর সময় পর্যন্তও পরগণাটি ওই নামেই পরিচিত ছিল। এরপর মসনদে আলী ঈশা খাঁ এ অঞ্চলে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি ও নেত্রকোনার রোয়াইলবাড়ি দুর্গের নিয়ন্ত্রণ নেন।
রোয়াইলবাড়ি থেকে জঙ্গলবাড়ি পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য একটি রাস্তাও ছিল জানিয়ে স্থানীয়রা বলেন, সে রাস্তাটি বর্তমানে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে এ স্থাপনাটি ঠিক কার সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এদিকে ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর তার পারিষদ দেওয়ান মজলিশ জালাল এখানকার আধিপত্য গ্রহণ করেন। তিনি রোয়াইলবাড়ি দুর্গের ব্যাপক সংস্কার এবং দুর্গের বাইরে একটি সুরম্য মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি ‘মসজিদ-এ জালাল’ বা ‘জালাল মসজিদ’ নামে পরিচিত ছিল। খননের পর এখানে কারুকার্যখচিত যে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে; অনেকের মতে- এটিই দেওয়ান জালাল নির্মিত ‘মসজিদ-এ জালাল’ বা ‘জালাল মসজিদ’। বর্তমানে জেলার হাওর উপজেলা মদনসহ জেলার অন্যান্য এলাকাতেও দেওয়ান মজলিশ জালালের বংশধরগণ রয়েছেন বলেও জানা যায়।