ঢাকা
২৬শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সকাল ৮:২৩
logo
প্রকাশিত : এপ্রিল ৮, ২০২৫

আমেরিকায় গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে চীন

২০২৫ সালের এপ্রিলে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের পারস্পরিক শুল্ক আরোপ নিয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের রাতের ঘুম হারিয়ে যেতে বসেছে তখন চীন তথাকথিতভাবে শান্ত থেকে আমেরিকায় বোল্টের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। বোল্টগুলো ডিসপ্রোসিয়াম, টারবিয়াম, টাংস্টেন, ইন্ডিয়াম এবং ইট্রিয়াম দিয়ে তৈরি- যে উপাদানগুলো ছাড়া আপনার বৈদ্যুতিক গাড়ি চলবে না, আপনার যুদ্ধবিমান উড়বে না, এমনকি সৌর প্যানেলগুলোর জন্যও এগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

ডিসপ্রোসিয়াম, টারবিয়াম, টাংস্টেন, ইন্ডিয়াম এবং ইট্রিয়াম হলো খনিজ পদার্থ যা বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে অথবা ক্লিনটেক প্রকল্পগুলো নিঃশব্দে বাতিল হওয়ার আগে থেকেই আলোচনায় ছিল।

সম্প্রতি আমি খনিজ পদার্থ সম্পর্কে এবং আমাদের অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পেরেছি। বৃটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে-এর ক্রিটিক্যাল মিনারেল ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের পরিচালক গ্যাভিন মাডের সাথে আমার ৯০ মিনিট সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল। কথা বলে আমি জানতে পেরেছি শক্তি-প্রযুক্তির এই সংমিশ্রণ ছাড়া মহাকাশে ক্ষমতা পুনর্নির্মাণ করা পশ্চিমাদের জন্য কতটা কঠিন। চীনের পদক্ষেপ আমাকে আরও গভীরে যেতে সাহায্য করেছে। আমি লাইল ট্রিটেনের নিকেল নার্ড-এর সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। যার খনিজ উত্তোলন এবং প্রক্রিয়াকরণের ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধ।

চীন যা করেছে তা কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না, অন্তত নামে নয়। তারা এটিকে রপ্তানি লাইসেন্সিং বলে উল্লেখ করেছে। আসলে এটি ছিল একটি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। এই লাইসেন্সগুলো বেইজিংকে কেবল এই উপকরণগুলো কোথায় যায় তা নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দেয় না, বরং কত দ্রুত, কত পরিমাণে এবং কোন রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক গ্রাহকদের কাছে যায় তার উপরও নিয়ন্ত্রণ দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরা যাক। তাদের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে গেলে ডিসপ্রোসিয়াম, টারবিয়াম, টাংস্টেন, ইন্ডিয়াম এবং ইট্রিয়াম দিয়ে তৈরি বোল্টগুলোর চূড়ান্ত ব্যবহারের স্থানও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে শেষ ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স অনুমোদিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। চীন দশকের পর দশক ধরে এই সরবরাহ শৃঙ্খলের উপর তার আধিপত্য গড়ে তুলেছে। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আউটসোর্সিংয়ের দিকে মনোনিবেশ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহের ক্ষেত্রে চীন যেসব উপকরণ নিষিদ্ধ করেছে, সেগুলো হঠাৎ করে নেয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়। ঠান্ডা মাথায় নির্ভুলতার সাথে বিবেচনা করে তবে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মার্কিন পণ্যের স্পেসিফিকেশন শিটে প্রথম যে নামটি আসে সেটি হলো ডিসপ্রোসিয়াম। যদি আপনার বৈদ্যুতিক মোটরকে উচ্চ তাপমাত্রায় কাজ করতে হয় তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডিসপ্রোসিয়ামযুক্ত নিউওডিয়ামিয়াম চুম্বক ব্যবহার করা হয়। ডিসপ্রোসিয়াম না থাকলে তাপীয় স্থিতিশীলতা আসে না। চীন মূলত ডিসপ্রোসিয়ামের সম্পূর্ণ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এটিকে বিদ্যুতায়নের মেরুদণ্ড বলা যেতে পারে। এই মুহূর্তে চীন সেই মেরুদণ্ডকে ধরে রেখেছে।

তারপর আছে টাংস্টেন। যে ধাতু বুলেটকে বুলেটপ্রুফ করে। আক্ষরিক অর্থেই। কিছু কাটতে, ড্রিল করতে, বা ভেদ করতে এটিকে ব্যবহার করা হয়। ওবামা প্রশাসনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এর উৎপাদনে মনোনিবেশ করেনি এবং চীন বিশ্বব্যাপী উৎপাদনের ৮০ শতাংশ অর্জন করে। আপনি ভিয়েতনাম বা পর্তুগাল থেকে টাংস্টেন আনতেই পারেন তবে তার জন্য গুনতে হবে তিন গুণ টাকা। টাংস্টেন কেবল গোলাবারুদে ব্যবহার হয় না। এটি সেমিকন্ডাক্টর চিপ, সিএনসি মেশিন টুলস এবং উচ্চ-কার্যক্ষমতাসম্পন্ন অ্যালয়গুলোর সার্কিট তৈরিতে কাজে লাগে। জেট ইঞ্জিন থেকে শুরু করে ডিপ-ড্রিলিং রিগ পর্যন্ত সবকিছুতে এর ব্যবহার রয়েছে।

ডিসপ্রোসিয়ামের মতো সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ টার্বিয়াম। আপনি কি আপনার ইভি এবং অফশোর উইন্ড টারবাইনে উচ্চ-দক্ষতাসম্পন্ন মোটর চান? নাইট-ভিশন গগলস, সোনার সিস্টেম, ম্যাগনেটোস্ট্রিকটিভ অ্যাকচুয়েটরেও লাগবে টারবিয়াম। ডিসপ্রোসিয়ামের মতো, টারবিয়াম প্রায় একচেটিয়াভাবে চীনা খনি থেকে আসে, সেখানেই প্রক্রিয়াকরণ করা হয় এবং চীনা আমলাদের থেকে তার লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়। ইন্ডিয়ামও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটি স্বচ্ছ পরিবাহী যা আপনার স্ক্রিনগুলিকে আলোকিত করে, আপনার ফাইবার অপটিক্স যোগাযোগ সংঘটিত করে। ইন্ডিয়াম ছাড়া, টাচস্ক্রিন ফোনগুলো আদতে পেপারওয়েট হয়ে যায় এবং ৫জি বেস স্টেশনগুলো কর্মক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে ইন্ডিয়াম উৎপন্ন হয় না। কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান কিছু উৎপাদন করলেও, বিশ্ব বাজার এখনও চীনা সরবরাহের উপর নির্ভরশীল।

তারপর আছে ইট্রিয়াম। এই উপাদানটি ছাড়া উচ্চ-তাপমাত্রার জেট ইঞ্জিনের আবরণ কাজ করে না, উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি রাডার সিস্টেম টিউন করে না এবং লেজারগুলো সারিবদ্ধ হয় না। এটি টারবাইন ব্লেডের উপর তাপীয় বাধার আবরণ হিসেবে কাজ করে যা বিমানের ইঞ্জিনগুলোকে উড্ডয়নের মাঝখানে গলে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। সাশ্রয়ী মূল্যের বিমান বানাতে গেলে ইট্রিয়াম ছাড়া তা বানানো সম্ভব নয়। এই খনিজটিও মেলে চীনা মাটিতে। সুতরাং এই খনিজগুলো ছাড়া প্রতিরক্ষা খাত অনেকটাই পঙ্গু হয়ে যাবে। এটা কেবল আপনি পরবর্তী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পারবেন কিনা তার প্রশ্ন নয়। আপনার পরবর্তী ক্ষেপণাস্ত্রটি সোজা উড়ে যাবে কিনা, নির্দিষ্ট জায়গায় আঘাত করবে কিনা এবং তাপের প্রভাবে ভেঙে পড়বে কিনা সেই প্রশ্নও উত্থাপন করে।

তারপর আছে সেমিকন্ডাক্টর। সবাই চিপস নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে কিন্তু কেউ উল্লেখ করে না যে আপনার উন্নত চিপস ইন্টারকানেক্টের জন্য টাংস্টেন এবং উচ্চ-গতির অপটোইলেকট্রনিক ইন্টারফেসের জন্য ইন্ডিয়াম প্রয়োজন। সেমিকন্ডাক্টর ছাড়া কেউ ৫জি অবকাঠামো তৈরি করতে পারবে না। চীন এক্ষেত্রে কৌশলগত দর কষাকষির অন্যতম মাধ্যম। মার্কিন উন্নত সামরিক ব্যবস্থা? তাদেরও চিপসের প্রয়োজন। এরপরই আসছে পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি বা ক্লিন টেকনোলজি এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের দেশীয় বাজারের জন্য ইভি, সৌর প্যানেল এবং বায়ু টারবাইন তৈরির স্বপ্নকে কঠিনভাবে আঘাত করতে চলেছে। ডিসপ্রোসিয়াম এবং টার্বিয়াম ছাড়া, আপনার ইভি মোটরটির কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। টেলুরিয়াম ছাড়া, ফার্স্ট সোলারের ক্যাডমিয়াম-টেলুরাইড প্যানেল- যা মার্কিন সৌর উৎপাদনের গর্ব-নির্মাণের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ইট্রিয়াম ছাড়া অফশোর বায়ু প্রকল্পের টারবাইন ব্লেডলোর আয়ুষ্কাল কমে যায়।

অর্থনৈতিক প্রভাবও মাথায় রাখতে হবে। এই উপকরণগুলোর দাম ইতিমধ্যেই বেড়ে গেছে এবং মোটরগাড়ি সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা বাজেট পর্যন্ত সবকিছুতেই খরচ বাড়তে শুরু করেছে। ছয় মাস আগে কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা সাহায্য করতে আগ্রহী ছিল, যদিও তারা রাতারাতি চীনকে প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। এখনও সময় আছে সঠিক পথ বেছে নেয়ার, যদিও তা অসম্ভব। এর জন্য ট্রাম্পকে প্রথমে তার মার্কিন অর্থনীতি ধ্বংসকারী, মন্দা সৃষ্টিকারী, শত্রু উৎপন্নকারী শুল্কনীতি প্রত্যাহার করতে হবে এবং সেই বাণিজ্য চুক্তিগুলোতে ফিরে যেতে হবে যা যুক্তরাষ্ট্রর জন্য এতদিন অবিচ্ছেদ্য ছিল। পরিশেষে বলা যায়, চীন ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কিছু উপাদানের মার্কিন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো ঠাণ্ডা মাথায় পারস্পরিক শুল্ক নিয়েই ভেবে যাচ্ছে।

সূত্র : ক্লিনটেকনিকা

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram