বিশ্ব অর্থনীতিকে টেকসইভাবে এগিয়ে নিতে হলে দেশগুলোর উচিত বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলা। বজায় রাখতে হবে আর্থিক স্থিতিশীলতা। এছাড়া দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
বিশ্ব অর্থনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। গত পাঁচ বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতির দৃঢ়তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যিক উত্তেজনা বেড়েছে। তীব্র হয়েছে নীতিগত অনিশ্চয়তা। এমন প্রেক্ষাপটে দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি অর্জন আগের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও মূলধন প্রবাহে ব্যাপক পুনর্বিন্যাস চলছে। বড় বড় অর্থনীতিগুলোতে চলছে নীতিগত মোড় নেওয়ার প্রস্তুতি। এতে নীতিনির্ধারকরা কঠিন আর্থিক পরিবেশ, উচ্চ বাজার অস্থিরতা ও অতীতের একাধিক সংকটের ফলে ভঙ্গুর নীতি-সহায়তা ব্যবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন।
তিনটি জরুরি অগ্রাধিকার
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তিনটি জরুরি অগ্রাধিকার সামনে এনেছে আইএমএফ।
প্রথমত, বাণিজ্য উত্তেজনা নিরসন ও আড়ালের কাঠামোগত বৈষম্যগুলো চিহ্নিত করে সমাধানে যেতে হবে। নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে—নিয়মভিত্তিক, সমতানির্ভর বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রতিযোগিতায় বাড়তি সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্যে বিকৃতিমূলক নীতির ব্যবহার ও অবাধ বাণিজ্য প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়।
দ্বিতীয়ত, সবাইকে অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় একযোগে কাজ করতে হবে। দেশগুলোকে নিজেদের অর্থনীতি সুসংগঠিত করতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য মধ্যমেয়াদি আর্থিক পুনর্গঠন পরিকল্পনা।
অন্যদিকে, উন্নত অর্থনীতিগুলোতে ব্যয় পুনর্বিন্যাস এবং উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোর জন্য রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রয়োজনে উভয় কৌশল গ্রহণেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে সংস্কারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহায়তার জন্য সময়োপযোগী, লক্ষ্যভিত্তিক ও অস্থায়ী সহায়তা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় দ্রুত ও অভিযোজিত নীতি গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছে আইএমএফ। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
তৃতীয় অগ্রাধিকার, প্রবৃদ্ধিকে দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখার জন্য গঠনমূলক সংস্কারে জোর দিতে হবে—বিশেষ করে উৎপাদনশীলতা ও সম্ভাব্য উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে। এজন্য শ্রমবাজার, পণ্যমূল্য বাজার ও আর্থিক বাজারে কাঠামোগত সংস্কার দরকার, যেখানে নিয়ন্ত্রক কঠোরতা বজায় রাখাও জরুরি।
দেশগুলোকে উদ্ভাবনে উৎসাহিত করতে হবে, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং অনাবশ্যক বিধিনিষেধ সরিয়ে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এর মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে, যাতে সমতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয় এবং বিকৃতিমূলক নীতির ব্যবহার বন্ধ করা যায়।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব
টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য—বিশেষ করে বৈশ্বিক ভারসাম্যহীনতা দূর করতে। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে তা বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত তৈরি করতে পারে, যা বৈশ্বিক মূলধন প্রবাহে প্রভাব ফেলে। এই ভারসাম্য পুনঃস্থাপন অভ্যন্তরীণ, বৈদেশিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখতে পারে।
প্রত্যেক দেশ যদি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়, তাহলে তা সামষ্টিকভাবে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের কল্যাণে ভূমিকা রাখবে।
আইএমএফ বলছে, বর্তমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বা পূর্বনির্ধারিত নয়। সচেতন, সুনির্দিষ্ট ও সুপরিকল্পিত নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে দেশগুলো পরিবর্তনশীল বাস্তবতা কাজে লাগিয়ে ঝুঁকি কমানো এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।
আইএমএফ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, নীতিনির্ধারকদের জন্য নির্ভরযোগ্য উপদেষ্টা, বৈদেশিক লেনদেন সংকটে সহায়তাকারী শেষ আশ্রয়স্থল, শক্তিশালী নীতি কাঠামোর প্রবক্তা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি সমন্বয়ক হিসেবেই তাদের ভূমিকা অব্যাহত থাকবে। চলমান পরিবর্তনের ধারায় সদস্য দেশগুলোর মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন মেটাতে আইএমএফ প্রতিনিয়ত নিজেদের অভিযোজিত করে চলবে।