ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর হাতে মিয়ানমারের পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ)-এর অংশ ‘পা কা ফা’ (পিকেপি) গোষ্ঠীর ১০ সদস্য নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে তিনজন কিশোর রয়েছে। এই ঘটনা ঘটেছে গত ১৪ মে ভারতের মণিপুর রাজ্যের চান্দেল জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায়। তবে এই অভিযানের ব্যাখ্যা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র মতানৈক্য।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, ১৪ মে ‘গোপন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে’ আসাম রাইফেলসের একটি দল অভিযানে গেলে ‘সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীরা’ তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এসময় পাল্টা অভিযানে ১০ জন নিহত হয়। তাদের কাছ থেকে একে-৪৭ রাইফেল ও একটি রকেটচালিত গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়।
কিন্তু নির্বাসিত মিয়ানমার সরকারের (ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট - এনইউজি) পক্ষ থেকে জানানো হয়, নিহতরা সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়াননি। তাদের ভারতের মাটিতে গ্রেফতার করে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মরদেহের অবস্থাও অত্যন্ত করুণ ছিল—পচে যাওয়া শরীরে পোকা জন্ম নিয়েছিল, জানিয়েছেন তামু এলাকার স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত একটি সংগঠনের সদস্য থিদা (ছদ্মনাম)।
১৪ মের এই ঘটনার পর তামু এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। কিন্তু এখন একবার শুরু হওয়ায় ভবিষ্যতে আরও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা বাড়ছে। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা এখন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
ঘটনার এক দিন পর ১৫ মে, তামুর পিপলস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন টিম নিহতদের দাহক্রিয়ার আয়োজন করে। এ সময় মরদেহগুলো কালো হয়ে ফুলে ওঠা অবস্থায় একটি প্লাস্টিকের চাদরে সাজিয়ে রাখা হয়। দ্রুত ব্যবস্থায় কাঠ ও পোড়া টায়ারে তৈরি অস্থায়ী চিতায় তাদের দাহ করা হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ১২ মে পিকেপির ওই ১০ সদস্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর আক্রমণ এড়িয়ে তামু এলাকায় নতুন ক্যাম্পে পৌঁছান। তারা তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে আগে থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে জানিয়েছিলেন। এমনকি ভারতীয় সেনারা ক্যাম্প পরিদর্শন করে বলেও দাবি করেন থিদা।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পরবর্তীতে দাবি করে, সীমান্ত এলাকায় চলমান কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজে বাধা দিতেই বিদ্রোহীরা আক্রমণ চালায় এবং সে কারণে পাল্টা অভিযানে তাদের হত্যা করা হয়।
তবে এই ঘটনার পর সীমান্ত বেড়া নিয়েও নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। মিয়ানমার ও ভারতের বহু নৃগোষ্ঠী সীমান্তের দুই পাশে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে এবং উন্মুক্ত সীমান্তব্যবস্থার মাধ্যমে যাতায়াত চালিয়ে আসছিল। এখন ভারত সেই সীমান্তে বেড়া নির্মাণ করে ‘ভৌগোলিক বিভাজন’ তৈরির চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মিয়ানমার ও উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী গবেষক অংশুমান চৌধুরী জানিয়েছেন, এই হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত এবং তা ভারত-মিয়ানমার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আগের ‘নীরব সমঝোতা’র ব্যত্যয় ঘটিয়েছে।
অংশুমান বলেন, এটি একটি নতুন উত্তেজনার সীমান্ত খুলে দিতে পারে। অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও এই ঘটনার দিকে সতর্ক নজর রাখছে। পরিস্থিতি দ্রুত ঘোলাটে হয়ে উঠতে পারে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে মিয়ানমারে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। এরপর থেকেই এনইউজি এবং পিডিএফের মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এতদিন এই বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ায়নি। কিন্তু তামুতে এই হত্যাকাণ্ড সেই নীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র: আল-জাজিরা