

মদন (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি: আজ ৬ আগস্ট, উচিতপুর ট্রাজেডির পাঁচ বছর চলে গেছে। ২০২০ সালের ৫ আগস্ট নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল মদন উপজেলার উচিতপুরে হাওরে এক মর্মান্তিক ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। আর এতে মুহূর্তের মধ্যে ঝরে যায় ১৮টি তাজা প্রাণ। ঘটনার পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও তদন্ত কমিটির কোন সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। দুর্ঘটনা রোধে পুলিশ ক্যাম্প ও দমকল কর্মীর ডুবুরি ইউনিট স্থাপন করার কথা থাকলেও কোন পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিনেই হাওর ভ্রমণ করছেন পর্যটন ও স্থানীয়রা।
জানা গেছে, বর্তমান সময়ের ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এক আকর্ষণীয় নাম উচিতপুর। হাওর উপকূলের এ এলাকাটি বছরের ছয় মাস (বর্ষাকাল) পানিবেষ্টিত থাকে। আর বাকি ছয় মাস অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে পরিণত হয় বিশাল কৃষি ভূমিতে। তবে বর্ষা এলেই যেন উচিতপুর তার প্রাণ ফিরে পায়। চারিদিক তখন কানায় কানায় পানিতে ভরে ওঠে। নজর কেড়ে নেয় দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল জলরাশি। দেখলে মনে হয়- কূলকিনারাহীন এক সাগর।
বছর আটেক আগে উচিতপুরের অদূরে বালই নদীতে একটি সুদৃশ্য পাকা সেতু নির্মাণের পর আশুলিয়ার মতো এ জায়গাটি ভ্রমণ পিপাসুদের আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়। তাই বর্ষা এলেই হাওরের উত্তাল ঢেউ আর স্বচ্ছ জলরাশির সৌন্দর্যের টানে ছুটে আসে হাজার হাজার পর্যটক। উচিতপুরের বিকল্প নাম হয়ে ওঠে মিনি কক্সবাজার। গোটা বর্ষাকাল জুড়েই দূর-দূরান্তের অগণিত মানুষের পদচারণে মুখর থাকে উচিতপুরের ট্রলার ঘাটটি। কিন্তু ২০২০ সালের ৫ আগস্ট এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় উচিতপুরে রাজ্যের বিষাদ নেমে আসে।
জানা গেছে, ওইদিন সকালে ময়মনসিংহ সদরের চরসিরতা ইউনিয়নের কোনাপাড়া, গৌরিপুর ও নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার তেলিগাতি এলাকার কয়েকটি মাদ্রাসা থেকে ৪৮ শিক্ষক-শিক্ষার্থী উচিতপুর হাওরে বেড়াতে আসেন। উচিতপুর ট্রলার ঘাটে এসে তারা কুলিয়াটি গ্রামের লাহুত মিয়ার ট্রলারে ওঠে হাওরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ঝড়ো হাওয়ার কারণে হাওরে সৃষ্ট উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি আড়াই কিলোমিটার দূরের রাজালীকান্দা নামক স্থানে ডুবে যায়। তখন প্রায় ৩০ জন যাত্রী সাঁতরিয়ে পাড়ে উঠতে পারলেও পানিতে ডুবে মারা যান ১৮ জন। ফলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় উচিতপুর ঘাটে। কান্নার রোল পড়ে যায় সারা হাওর জুরে।
এদিকে ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে বসে। জেলা প্রশাসক মদন উপজেলার তখনকার নির্বাহী কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদকে প্রধান করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ঝড়ো বাতাস ও ঢেউকে দায়ী করে ১৯ আগস্ট জেলা প্রশাসক বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করেন। তবে ভবিষ্যতে উচিতপুর এলাকায় নৌদুর্ঘটনা রোধে বেশকিছু সুপারিশ উল্লেখ করেন তারা। এর মধ্যে রয়েছে: নৌযানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম রাখা, নৌযানের রেজিষ্ট্রেশন, ফিটনেস পরীক্ষা, অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে পরিবহন বন্ধ করা, চালকদের প্রশিক্ষণ, ডুবরি ইউনিট গঠন ও পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন প্রভৃতি।
এছাড়া দুর্ঘটনার পর ভাই ভাই পরিবহন নামক ট্রলারটির মালিক লাহুত মিয়া, চালক আল আমিন ও কামরুল ইসলামকে আসামি করে ঢাকার নৌ আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল রাতে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় মদন থানা পুলিশ। সপ্তাহের মধ্যেই জামিনে চলে আসে আসামিরা। এদিকে এবারের বর্ষায়ও জমে ওঠেছে উচিতপুর ট্রলার ঘাট। দূর-দূরান্ত থেকে আসছে অগণিত যাত্রীবাহী ট্রলার ও কিছু কিছু ভ্রমণ পিপাসু। আর এ সুযোগে অতীতের মতো এবারও যাত্রী পরিবহনের প্রতিযোগিতায় নেমে গেছেন ট্রলার মালিকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঘাটে স্থানীয় প্রশাসনের তেমন নজরদারি নেই। ট্রলার মালিক, চালক ও যাত্রীরা কোন বিধিনিষেধই মানছেন না। প্রতিটি নৌকায় লাইফ জ্যাকেট, বয়াসহ জীবনরক্ষার সরঞ্জামাদি রাখার শর্ত দেয়া হলেও তা করছে না কেউই। পরিবহন করা হচ্ছে ধারণ ক্ষমতার অধিক যাত্রী। চালানো হচ্ছে ফিটনেসবিহীন নৌকাও। অনেক ছোট এবং পুরনো ভাঙ্গাচোরা নৌকায়ও ইঞ্জিন স্থাপন করে বানানো হচ্ছে ট্রলার। ফলে আবারও দেখা দিয়েছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এদিকে তদন্ত কমিটির সুপারিশে দমকলবাহিনীর ডুবুরি ইউনিট রাখার প্রস্তাব করা হলেও অদ্যাবধি ডুবুরি দল পাঠানো হয়নি সেখানে। ট্রলার ঘাটে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়নি।
এসব অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ অলিদুজ্জামান বলেন, আমি মদন উপজেলায় কিছুদিন আগে যোগদান করেছি। ট্রলার ডুবির বিষয়টি আমি শুনেছি। ট্রলার মালিকদের উদ্বুদ্ধ করব- যাতে তারা প্রতিটি নৌকায় জীবন রক্ষা সরঞ্জামাদি রাখে। তাছাড়া উপজেলা পরিষদ থেকে ট্রলারে জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম দেয়ার চিন্তা আছে। ডুবুরি ক্যাম্প কিংবা নৌ পুলিশের বিষয়ে আমার জানা নাই।

