গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি: রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত বালাদেশের জুলাই যোদ্ধা ইয়াসিনের লাশ পড়ে আছে রাশিয়ায়। নিহতের বড় ভাই মো. রুহুল আমিন শেখ জানায়, রস্তু বন্ধন ক্যান্টনম্যান হাসপাতালে ইয়াছিন মিয়া শেখের মৃতদেহ সুরক্ষিত রয়েছে। বিষয়টি অবগত করে দ্রুত লাশ আনার দাবি জানিয়ে সোমবার (২০ মে) ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক বরাবরে আবেদন করা হয়েছে।
অপরদিকে বাংলাদেশ দূতাবাস, মস্কো রাশিয়া (শ্রম কল্যাণ উইং) এর প্রথম সচিব (শ্রম) মো. মাজেদুর রহমান সরকার এক পত্রে জানান, কূটনৈতিক পত্র প্রেরণ, ইয়াসিন মিয়া শেখ এর মৃতদেহ চিহ্নিতকরণ, দূতাবাসকে অবহিতকরণ ও দ্রুত দেশে প্রেরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাশিয়ার পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। ইয়াছিন মিয়া শেখ ছিল জুলাই বিপ্লবের অগ্রভাগের সৈনিক। গত ২৭ মার্চ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনের মিসাইল হামলায় নিহত হয় ইয়াসিন।
শনিবার (২৪ মে) সরেজমিনে নিহত ইয়াসিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুত্র ইয়াসিনের শোকে শয্যাশায়ী মা ফিরোজা বেগম। পুত্র শোকে শয্যাশায়ী হলেও বারবার ছেলের ছবিতে হাত বুলাচ্ছেন তিনি। বাড়ির পাশ দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজলেই ছুটে যান। এতো ইয়াসিন আসছে, ইয়াসিন আসছে বলে চিৎকার শুরু করেন। তিনি বলেন, তোমরা আমার ছেলেকে এনে দাও। আমার সোনা মানিকের লাশটা স্পর্শ করে দেখি। তিনি আরও জানায়, ২৬ মার্চ শেষ কথা হয়। টাকা পাঠাবো, ঘর বানাবো, আরও কতো কথা বলেছে আমার ছেলেটা। এটাই ছিলো ওর সাথে শেষ কথা।
ইয়াছিন সেনাবাহিনীতে যোগ দিবে এটা ছিলো তার বাবার ইচ্ছে। ডৌহাখলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৯ এসএসসি পাশ করে। এরপর দেশে সৈনিকে যোগ দিতে একাধিকার সেনাবাহিনীর লাইনেও দাঁড়িয়েও চাকুরির সুযোগ হয়নি। ২০২১ সালে গৌরীপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা মিরপুর বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজে বিবিএতে অধ্যয়নরত ছিলেন ইয়াসিন।
ইয়াসিন তার আইডিতে পোস্টকৃত ভিডিও বার্তায় জানায়, গত বছরের জানুয়ারিতে রাশিয়ায় একটি কোম্পানিতে চাকুরির জন্য আবেদন করে। গত সেপ্টেম্বর মাসে অফার লেটার পেয়ে চলে যায় রাশিয়া। মস্কো থেকে প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার দূরের ওই কোম্পানিতে তিন মাস চাকুরির পর অনলাইনে আবেদন করে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক সৈনিক হিসেবে যোগ দেন।
তিনি জানান, দেশে না হলেও বিদেশে সৈনিক হয়ে বাবার স্বপ্নপূরণ হয় বলেও জানায় সে। ওই ভিডিওতে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিচারণ ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের জন্যও দোয়া প্রার্থনা করেন সাবেক এই ছাত্রদল কর্মী। যুদ্ধে মৃত্যু হলেও তার কোনো আফসোস থাকবে না বলে ভিডিও বার্তায় জানিয়ে দেয় ইয়াসিন। সে আরও উল্লেখ করে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে আন্দোলনে গিয়েছি, হরতাল-জ্বালাও-পোড়াও এর ভিতর দিয়ে অসংখ্যবার জীবনকে বাঁচিয়ে রেখেছি। সেদিন বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় বেড়িকেটে পড়েছিলাম। সেই বেড়িকেট ভেঙে এসেছি। জুলাইয়ের দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধে বারবার দেশীয় শত্রু মোকাবেলা করেছি। ঢাকার রাজপথে মিছিল-মিটিং করেছি। পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ওদেরকে প্রতিহত করেছি। এতে আমি যুদ্ধে যাওয়ার সাহস পেয়েছি, যুদ্ধে মৃত্যু হলেও আমার এখন কোনো আফসোস থাকবে না।
তার বাবার মৃত্যু হয় ২০১৬ সানের ১ মার্চ। বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর পোশাক পড়ে নিজের শরীরের পোশাক স্পর্শ করে ইয়াছিন বলেছিলো, বাবার মৃত্যুবার্ষিকী এই পোশাক বাবাকে উৎসর্গ করলাম। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস-জীবন যুদ্ধের এক ইতিহাস এখন ইয়াসিন! ওই ভিডিওটি ফেসবুকে পোস্ট করার মাস না পেরুতেই যুদ্ধে ইউক্রেনের মিসাইল হামলায় নিহত হয় তিনি।
ইয়াসিন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের মরিচালী গ্রামের মৃত আব্দুস সাত্তার মীরের পুত্র তিনি। গত ২৭ মার্চ তিনি যুদ্ধে নিহত হন। এ খবর পরিবার জানতে পারে ১ এপ্রিল। তবে তখনো তাঁর লাশের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিলো না।