শহিদ জয়, যশোর: অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেছেন, বিচারকরা জামিনের জন্য সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নন। তাদেরকে মামলার নথির ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে সেই নথির কথায় শেষ নয়। এই ক্ষেত্রে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হবে। নতুন করে জুরিস ফুটেজ তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে কোন ক্রমেই যেন জুলাই বিপ্লবের বিরোধীতাকারী কোন আসামি আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। বার ও বেঞ্চ এক হয়ে ৫ আগষ্ট পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে এক হয়ে কাজ করতে হবে। ৩৬ জুলাই আন্দোলনের বিরোধীতাকারী যেন কোন ভাবেই আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে বিচারের হাত থেকে রেহাই না পায়, জামিন না পায়-সে ব্যাপারে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। বিগত সরকার দেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করেছিলো সেই জায়গা থেকে জাতিকে বের করে আনতে হবে। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল স্পিরিটকে ধারণ করতে হবে। বাংলার মাটিতে যেন ভবিষ্যতে আর কোন ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে প্রত্যেককে তার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেজন্যই আজকের এই আয়োজন। এর মাধ্যমে আমাদের উপস্থিত সকলকে একমত হয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করতে হবে।
শনিবার দিনব্যাপী যশোর পিটিআই স্কুল অডিটোরিয়ামে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও পরিবেশের ওপর গুরুত্বসহ আইন প্রয়োগ বিষয়ক এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড: নাসিমুল গণির সভাপতিত্বে কর্মশালায় বিশেষ অতিথি ছিলেন আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চীফ প্রসিকিউটর (এ্যাটর্নি জেনারেল, আইসিটি) তাজুল ইসলাম ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) প্রখ্যাত সাংবাদিক মনির হায়দার। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, অতিরিক্ত আইজিপি(সিআইডি) সহ খুলনা ও বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনারবৃন্দ, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১৬ জেলার পুলিশ সুপারবৃন্দ, জেলা প্রশাসকবৃন্দ, জেলা ও দায়রা জজবৃন্দ, চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটবৃন্দ, সকল জেলার পাবলিক প্রসিকিউটরবৃন্দসহ প্রশাসন ও বিচার বিভাগের উর্ধ্বতন ৩ শতাধিক কর্মকর্তাবৃন্দ এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান অতিথি তার বক্তৃতায় বলেন,গত ১৬ বছরে ফ্যাসিষ্ট শেখ হাসিনার সরকার দেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। এই দেশের বিচার ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল। বিচারের নামে প্রহসন সৃষ্টি করা হযেছিল। দেশে আয়না ঘর তৈরি করে চরমভাবে মানবাধিকার লংঘন করা হয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অন্য একটি দেশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। দেশের প্রশাসন যন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছিল। পুলিশকে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর ভেতরে আয়না ঘর তৈরি করা হয়েছিলো, বাংলাদেশের নিরাপত্তার মধ্যে অন্য একটি রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ঢুকে পড়েছিলো। কিভাবে তারা এই দেশকে শাসন আর শোষণ করেছে তা গোটা জাতি দেখেছে। জাতি এই অবস্থা আর দেখতে চায় না।
বিচারকদের উদ্দেশ্য করে প্রধান অতিথি বলেন, মাননীয় বিচারকগণ, আপনাদের প্রো এ্যাকটিভ হয়ে বিচারকার্য চালাতে হবে। নতুন করে জুরিস ফুটেজ তৈরি করে বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে বিচার কাজ চালাতে হবে। মনে রাখতে হবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে নতুন দেশ আমরা পেয়েছি সে অর্জন যেন কোন ভাবেই বৃথা না যায়।
তিনি বলেন, দেশের মানুষ আর কোন ফ্যাসিষ্টটের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা দেখতে চায় না। আজ যারাই ফ্যাসিষ্টদের পক্ষ অবলম্বন করবে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে। যাদের নেতৃত্বে হামলা হয়েছে, খুন হয়েছে, গুম হয়েছে তাদের প্রতি কোন অনুকম্পা দেখানো চলবে না। নতুন বাংলাদেশে কোন ফ্যাসিবাদের স্থান হবে না। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন দমাতে যাদের যাদের ভূমিকা ছিলো তারা সবাই ফ্যাসিষ্ট। তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হবেই। যারা এই জুলাই বিপ্লবকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে তারাই জাতির শত্রু।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর (এ্যার্টনি জেনারেল) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম তার বক্তৃতায় বলেন, বন্দুকের ক্ষমতার জোরে গত ১৬ বছর ফ্যাসিষ্ট আওয়ামীলীগ সরকার দেশের বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো, পুলিশী কাঠামো পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করেছে। তারা দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিলো। ৩৬ জুলাই আন্দোলনে কিভাবে পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করেছিলো সে দৃশ্য বিশ্ববাসী দেখেছে। দেশ আজ একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই আছি। ফলে স্বাভাবিক ভাবে কোন কিছু নেওয়ার অবস্থায় আমরা নেই। আজ নতুন করে আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছি। আমি দ্বিধাহীন কন্ঠে বলতে চাই, পুলিশের যে সকল আইজিপি, যে সকল ডিআইজি, যেসকল এসপি যে সকল ডিসি রাতের ভোটে সহায়তা করে দেশে ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলো-তারা যতই শক্তিশালী হোক তাদেরকে কোন ছাড় দেওয়া হবে না বলে তিনি উপস্থিত সবাইকে সতর্কতার সাথে ন্যায় নিষ্ঠার সাথে স্ব স্ব অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের আহবান জানান।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সাংবাদিক মনির হায়দার বলেন, আমাদের সন্তানরা বুকের রক্ত দিয়ে যে দেশকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করেছে, সেই দেশে নতুন করে কোন ফ্যাসিবাদ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে তার জন্য সকলকে সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিগত ফ্যাসিবাদের আমলে পুলিশ যে ভাবে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে গোটা জাতির কাছে গণশত্রুতে পরিণত হয়ে উঠেছিলো সেই জায়গা থেকে ধীরে ধীরে বের হতে হবে। জনবন্ধব কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করতে হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড: নাসিমুল গনি তার বক্তৃতায় বলেন, রাষ্ট্রে ন্যয় নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে রাষ্ট্রের ও জনগণের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পরকালের ভয়ে সবাইকে টটস্থ থাকতে হবে। সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মনে রাখতে হবে আমরা কেউ আইনের উর্ধ্বে নই। আপনরা সকলেই রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ, কোন দল বা ব্যক্তির প্রতি নয়। মনে রাখবেন ব্যক্তির চেয়ে দেশ অনেক বড়। দেশ থাকলেই আমরা থাকতে পারবো। দেশে কোন ফ্যাসিবাদ বা তাদরে দোসরদের স্থান হবে না।
দুপুরের পরে গ্রুপ ভিত্তিক আলোচনার ম্যাধ্যমে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় সে সব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কর্মশালায় খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার ও ১৬ জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ পুলিশ সুপার, পুলিশ কমিশনার, জেলা ও দায়রা জজ, সিনিয়র জুডিশিয়াল ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পাবলিক প্রসিকিউটর, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সহ ৩২০জন কর্মকর্তা অংশ নেন।