

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ বর্তমানে দেশজুড়ে প্রধান আলোচনার বিষয়। বিশেষ করে ‘গণভোট’ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল নভেম্বরেই বা নির্বাচনের আগে গণভোট চায়। অন্যদিকে বিএনপিসহ দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের দিন গণভোট চায়।
এই ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বক্তৃতার মঞ্চসহ প্রায় সবখানে চলছে তুমুল তর্ক-বিতর্ক। তবে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হওয়ার পরও সর্বোচ্চ ধৈর্য দেখাতে চায় বিএনপি। কোনো ধরনের শক্তি প্রদর্শন বা রাজপথের কর্মসূচি দিয়ে দেশে আপাতত বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করতে চায় না দলটি। বিএনপি আশা করছে, প্রধান উপদেষ্টা বাস্তবতার নিরিখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন।
কারণ সুপারিশ করলেই সেটা সিদ্ধান্ত হতে পারে না। সুতরাং জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই গণভোট মানা হবে না।
কারণ জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশ ও দেশের জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে। এখনো দিচ্ছে।
অন্যদিকে জামায়াত নিজেদের স্বার্থে প্রশাসনে দলীয়করণ করলেও বিএনপি সে পথে হাঁটেনি। দ্রুততম সময়ে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে সরকার গঠনের কথা বলে আসছে বিএনপি। যে কারণে বিএনপি সব সময় শান্তি ও চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে, দিচ্ছে। কিন্তু কোনো অশুভ পক্ষ যদি দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চায়, নির্বাচন বানচাল করতে চায়, তাহলে বিএনপি বসে থাকবে না। দেশ ও জনগণের স্বার্থে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামতে বাধ্য হবে দলটি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গত বুধবার রাতে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের বিষয়েই মূল আলোচনা হয়। এতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। সেখানে আপাতত সর্বোচ্চ ধৈর্য দেখানোর বিষয়ে একমত হন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। এরপর গত বৃহস্পতিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও এমন ইঙ্গিত দেন দলের নেতারা।
তাঁরা বলছেন, বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। এই মুহূর্তে তাদের জনসমর্থন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তাদের বড় কোনো কর্মসূচিতে লাখ লাখ লোকের সমাগম হয়। রাজধানীসহ সারা দেশে বিএনপি ইচ্ছা করলে বড় ধরনের শোডাউন করতে পারে। কিন্তু কিছু দিন রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের মতপার্থক্য তৈরি হলেও তারা অনেকটা ধৈর্য ধারণ করছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভা সূত্র জানায়, বিএনপি এখন সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ করতে চায়। তাদের মূল লক্ষ্য যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া। এ জন্য তারা যত ছাড় দেওয়ার তা দিয়েছে। গণভোটসহ আরো যেসব ইস্যু আছে সেখানেও তারা নমনীয় থাকতে চায়। তাদের কথাগুলো তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে পৌঁছে দেবে। তবে তা আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নয়। মিডিয়ার মাধ্যমে, বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে, প্রয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তারা অনৈক্যের বিষয়গুলো জানাবে। কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচনের আগে দলটি গণভোট মেনে নিবে না। গণভোট হলে নির্বাচনের দিনই হতে হবে। আর যদি কোনো কারণে নির্বাচনের আগে গণভোটের সম্ভাবনা তৈরি হয়, তাহলে বিএনপি বসে থাকবে না। হয়তো তখন আর ধৈর্য ধারণ করা হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যাপারে জাতির সামনে কমিটমেন্ট দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। আমরা তাতে আস্থা রেখেছি। জাতির স্বার্থে নির্বাচনের দিন গণভোটে আমরা একমত হয়েছি। এর বাইরে অন্য কোনো দিন বা নির্বাচনের আগে আমরা গণভোট মেনে নেব না। আমরা আমাদের মতামত জাতির সামনে তুলে ধরলাম। প্রয়োজনে আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে যাব।’
মির্জা ফখরুল আরো বলেন, ‘আমরা কোনো কর্মসূচিতে এখন যাব না। নির্বাচন নিয়ে আমাদের কাছে কোনো ধোঁয়াশা নেই। সরকার ও নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে এটা একটি সুপারিশ। এর মধ্যে যে ত্রুটিগুলো আমরা পেয়েছি তা উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। সব ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল একমত নাও হতে পারে। এ জন্য নোট অব ডিসেন্ট দিয়েও একমত হওয়া যায়। আমরা চাই ঐকমত্য কমিশনে যা সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা ডকুমেন্টেড আছে সে ব্যাপারে সুপারিশ করা হোক।’
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এর মধ্য দিয়ে কমিশন চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে কার্যত অনৈক্য সৃষ্টি করছে। বিএনপি এখন মনে করছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং আরো দু-একটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ। অথচ বিএনপি সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার হওয়া সত্ত্বেও কমিশনের সুপারিশে তাদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে, বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সনদে লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা রাখা হয়নি। এতে বিএনপি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।
সভা সূত্র জানিয়েছে, স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুপারিশকে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জারীকৃত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) এবং আইয়ুব খান প্রবর্তিত বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি মনে করেন, কমিশনের সুপারিশে দুটি দলের প্রস্তাব ও ঐকমত্য কমিশনের চিন্তা-ভাবনা জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার থেকে নির্বাচনের আগে গণভোটের বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যাপারে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন। কমেন্টে মতামতও পড়ছে বেশ। তবে বিএনপির অ্যাক্টিভিস্টরা ‘না’ এর পক্ষে কাজ করছেন। তাঁরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে জামায়াতের অ্যাক্টিভিস্টরা ‘হাঁ’ এর পক্ষে পোস্ট দিচ্ছেন। তবে নির্বাচনের আগে গণভোটের বিষয়ে ‘না’ এর পক্ষেই বেশি মতামত দেখা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘গণভোট নির্বাচনের আগে হবে বা নির্বাচনের দিন হবে, এটা নিয়ে যে বিরোধ হচ্ছে এটা রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের ব্যাপার। আগে হলে কী হবে আর নির্বাচনের দিন হলে কী হবে, সেটা সাধারণ মানুষ বোঝে না। তবে এটা ঠিক, এতে রাজনৈতিক অনৈক্য বাড়ছে। এতে ফ্যাসিবাদী শক্তির তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে চললে ফ্যাসিবাদী শক্তি ফিরে আসার পথও সৃষ্টি হতে পারে।’

