ঢাকা
২৮শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রাত ১০:৩৩
logo
প্রকাশিত : মে ২৬, ২০২৫

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য বাড়বে, বেশি ভুগবে নিরীহরা

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভে উত্তাল ছিল প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়। গত বৃহস্পতিবার (২২ মে) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া অনুমোদনের পর এর বিরোধিতা করছেন সরকারি চাকরিজীবীরা।

খসড়ায় সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত চারটি অপরাধের জন্য বিভাগীয় মামলা ছাড়াই চাকরিচ্যুতির সুযোগ রাখা হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এটিকে নিবর্তনমূলক (যে আইন সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকার সীমিত করে) দাবি করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান।

সরকার যখন দুর্বল হয় তখনই কিন্তু সে নিবর্তনমূলক আইনের আশ্রয় নেয়। কারণ, তার তো আর কোনো উপায় নেই। দক্ষতা, যোগ্যতা ও নেতৃত্ব দিয়ে তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সেজন্য তারা (সরকার) কঠোর আইনের দিকে যাচ্ছে।- মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া

তবে কর্মচারীদের আন্দোলনের মধ্যেই রোববার (২৫ মে) সন্ধ্যায় চার অপরাধের জন্য চাকরিচ্যুতির বিধান রেখে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছেন রাষ্ট্রপতি। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘জঙ্গি আইন’ আখ্যা দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, এতে অনেক নিরীহ কর্মচারী কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাকরিচ্যুত হবেন। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সহজে দুর্নীতি করতে পারবে এবং চাকরির ভয় দেখিয়ে হয়রানি ও নিপীড়নের স্টিম রোলার চালাবে। এতে সবচেয়ে বেশি ভুগবে নিরীহ কর্মচারীরা।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেই প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন কঠোর করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে কোনো নিবর্তনমূলক আইন করা যাবে না। চাইলেই যে কাউকে চাকরিচ্যুত করার বিধান ভবিষ্যতে অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে চাকরিচ্যুতির মতো কঠিন শাস্তি দিতে হবে।

এটি সংবিধানের লঙ্ঘন, এটি কালাকানুন। এ ধরনের জঙ্গি আইন পাস করা উচিত না।- আবু আলম মো. শহীদ খান

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় প্রশাসনে। নাজুক পরিস্থিতির সুযোগে দাবি-দাওয়া আদায়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ডিসি নিয়োগকে কেন্দ্র করে কর্মকর্তাদের মধ‌্যে হাতাহাতির মতো নজিরবিহীন ঘটনাও ঘটে। অবরুদ্ধ করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের। এতে ব্যাহত হচ্ছিলো স্বাভাবিক কাজকর্ম। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ এখনো কাজে অনুপস্থিত রয়েছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছিল সরকার। এ পেক্ষাপটেই আইন সংশোধন করে কঠোরতার বিষয়টি সামনে আসে।

আন্দোলন-বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছিলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে সম্প্রতি ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯’ ফের কার্যকর করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধান অধ‌্যাদেশের আদলে ২০১৮ সালের চাকরি আইন সংশোধনের উদ‌্যোগ নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রণয়ন করা হয় ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া।

অনেক নিরীহ কর্মচারী কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাকরিচ্যুত হবেন। এতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সহজে দুর্নীতি করতে পারবে ও চাকরির ভয় দেখিয়ে হয়রানি ও কর্মচারী নিপীড়নের স্টিম রোলার চালাবে।- বাদিউল কবীর

এ অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকারি কোনো কর্মচারী যদি এমন কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, যার কারণে অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে; অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে, ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া নিজ কর্মে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন; অন্য যেকোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন; যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন- তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন।

দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্নবেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ বা চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্তের মতো দণ্ড প্রদান করা যাবে বলে খসড়া অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত ২২ মে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ‌্যাদেশটির খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর গত শনিবার সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবগুলো সংগঠন একযোগে বিক্ষোভ করে। রোববারও এরকমই পরিস্থিতি ছিল সচিবালয়ে।

অধ্যাদেশটি জারির আগে রোববার বিকেলে এ নিয়ে সঙ্গে কথা হয় বিশেষজ্ঞদের। তাদের একজন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকার যখন দুর্বল হয় তখনই কিন্তু সে নিবর্তনমূলক আইনের আশ্রয় নেয়। কারণ, তার তো আর কোনো উপায় নেই। দক্ষতা, যোগ্যতা ও নেতৃত্ব দিয়ে তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সেজন্য তারা (সরকার) কঠোর আইনের দিকে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘কঠোর আইন করার বিষয়টিকে আমি একেবারে খারাপ বলবো না। এখন কর্মচারীরা নিজেদের স্বার্থের জন্য নেমেছেন, তাদের গোষ্ঠী স্বার্থের জন্য সোচ্চার হয়েছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় অচলাবস্থা, মানুষ সঠিকভাবে সেবা পাচ্ছে না। মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে।’

‘অন্যায্য আন্দোলন দমনের জন্য কঠোর আইন দরকার আছে। তবে সেটা নিবর্তনমূলক হবে না। আমি যাকে খুশি তাকে তার চাকরি খেয়ে ফেলবো, সেটা হবে না। যারা অন‌্যায‌্য আন্দোলন করে, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে, জনসেবাকে বিঘ্নিত করে, রাস্তাঘাট বন্ধ করে তাদের শায়েস্তা করার জন্য কঠোর আইনের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এই আইনের মাধ্যমে নিরীহ কর্মচারীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কর্মচারীদের ভয়টা তো ওখানেই।’

সাবেক আমলা ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, ‘তারা (নিরীহ কর্মচারীরা) মনে করে আন্দোলন করবে নেতারা, তারা তো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী থাকে, তাদের চাকরি যাবে না। চাকরি তো যাবে নিরীহদের। ভয়টা এখানেই। এ ধরনের আইনের অপপ্রয়োগের ভয়টা বেশি।’

তার ভাষ্য, ‘আইন কঠোর হোক, তবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে, নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর সেই তদন্তে কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হয় তবে তাকে সাজা দেওয়া হোক। সেই প্রক্রিয়ার সময়টা সংক্ষিপ্ত হোক।’

১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধানের আলোকে সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের সমালোচনা করে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘এটা একটা কালা কানুন। ১৯৭৯ সালে বিশেষ বিধান আইন করা হয়েছিল তৎকালীন সময়ে ব্যাংকিং খাতে যে একটা চরম অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল সেই প্রেক্ষাপটে, এবং সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তখন এটা মার্শাল ল অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে করা হয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘কোনো মার্শাল ল অর্ডিন্যান্সকে আপনি গণতান্ত্রিক বলতে পারবেন না। সেটিকে আপনি রিভাইভ করে সরকারি কর্মচারীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে বিদায় করে দেবেন, কাজটি আপনি আপনার গৃহ সহকারীর ক্ষেত্রেও করতে পারেন না। এটি সংবিধানের লঙ্ঘন, এটি কালাকানুন। এ ধরনের জঙ্গি আইন পাস করা উচিত না।’

তিনি আরও বলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রের চাকরি পাওয়াটা একটা প্রক্রিয়ার ব্যাপার। বিভিন্ন পর্যায়ে পরীক্ষা, অপেক্ষা, তারপর নিয়োগ হয়। সেক্ষেত্রে এত সহজে তাকে চাকরি থেকে বিদায় করে দেওয়া এটাতো মামা বাড়ির আবদার না!’

‘এই আইন বাস্তবায়ন করলে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য গঠন করা হয়েছিল সে কথা বলার আর সুযোগ থাকবে না’- মন্তব‌্য করেন সাবেক এ আমলা।

রোববার সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবগুলো সংগঠনের সম্মিলিত আন্দোলনে উত্তাল ছিল সচিবালয়। সকাল ১০টা থেকে বিপুল সংখ‌্যক কর্মচারী মিছিল নিয়ে সচিবালয় প্রদক্ষিণ করেন। কিছু সময়ের জন‌্য সচিবালয়ের প্রধান ফটক আটকে সভা ও মিছিলও করেছেন তারা। কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন।

অধ‌্যাদেশ প্রত‌্যাহার না হাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব‌্যাহত রাখা এবং আরও কঠোর করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন কর্মচারী নেতারা।

বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর বলেন, ‘১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধানের প্রস্তাবিত ধারাগুলো বাংলাদেশ সংবিধানের ১৩৫(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক, যা অধ্যাদেশ দ্বারা প্রবর্তন করা হয়েছিল। এটা সাধারণ নাগরিক ও কর্মচারীদের ন্যায্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক হওয়ায় সরকারের উচ্চ আদালতের মাধ‌্যমে নিষিদ্ধ বা বাতিল করা হয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত ধারাগুলো চাকুরি আইনে সংযোজন করা হলে অনেক নিরীহ কর্মচারী কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাকরিচ্যুত হবেন। এতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সহজে দুর্নীতি করতে পারবে ও চাকরির ভয় দেখিয়ে হয়রানি ও কর্মচারী নিপীড়নের স্টিম রোলার চালাবে।’

বাদিউল কবীর বলেন, ‘আমরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেছি। কিন্তু কেউ আমাদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। অধ‌্যাদেশ প্রত‌্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’

আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সমন্বয়ক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার এ সময়ে কেন এমন একটি অধ‌্যাদেশ করতে যাচ্ছে আমরা জানি না। এ আন্দোলন সচিবালয়ের বাইরে বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে। অধ‌্যাদেশ প্রত‌্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলবে।’

সরকার সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে আগামী দিনে পূর্ণ কর্মবিরতি ও সচিবালয় অচল করে দেওয়ার মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী কোনো কোনো নেতা।

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram