তারেক পাঠান, পলাশ (নরসিংদী) প্রতিনিধি: দালালের খপ্পরে পড়ে রাশিয়া গিয়ে চাকরির নামে রুশ বাহিনীর হয়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রাণ হারালেন নরসিংদীর পলাশ উপজেলার সোহান মিয়া নামে এক যুবক। গত ২১ জুন শনিবার বিকাল সাড়ে তিনটায় সোহানের বন্ধু সহযোদ্ধা জাফরের ফোনের মাধ্যমে সোহানের মার ফোনে খবর আসে সোহান যুদ্ধে মারা গেছে। পরে ফোনে সোহানের মরদেহের ছবিও পাঠায় জাফর। মৃত্যুর খবরে সোহানের বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে।
সরেজমিনে সোহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তার বাড়িসহ গোটা গ্রামে চলছে শোকের মাতম। চাকরির আশায় বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিলেন উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের সোহান মিয়া ও তাঁর বোনের জামাই আকরাম মিয়া। ইচ্ছা ছিল ইউরোপে গিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদল করবেন। সেজন্য ধারদেনা করে ১৪ লাখ টাকার বিনিময়ে দেশ ছাড়েন তারা।
দালালচক্র তাদের রাশিয়া নিয়ে গেলেও তাদের কথামতো চকলেট কারখানায় কাজ না দিয়ে রাশিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়। ফলে সে দেশে গিয়ে সোহানকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার জন্য অস্ত্রের প্রশিক্ষণে নামতে হয়েছে। তবে তাঁর বোনজামাই আকরাম মিয়া কৌশলে পালিয়ে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। সোহান মিয়া পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের মৃত সোহরাব মিয়ার ছেলে। পরিবারে তাঁর মা নূর ন্নাহার ও স্ত্রী হাবিবা আক্তার এবং তাঁর ১৬ মাসের ছেলে ফারহান রয়েছে।
রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা সোহানের বোনজামাই সরকারচর গ্রামের কাজল মিয়ার ছেলে আকরাম মিয়া। সোহানের বড় চাচা রেজাউল আলম রিপন জানান, ঢাকার বনানীর ড্রিম হোম ট্রাভেলস থেকে জেরিন নামে এক দালালের মাধমে সাইপ্রাস যাওয়ার জন্য কাগজপত্র জমা দেন তারা। কিন্তু দীর্ঘদিন পর দালাল চক্র রাশিয়ার ভিসা করে দেন তাদের। পরে ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর ১০ জনের একটি দল রাশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর সেখানে তাদের ৪ দিন রাখে। কিন্তু সোহানসহ আরও দু'জনকে একদিন পরই সেখান থেকে নিয়ে যায় রাশিয়ার সেনা ক্যাম্পে। নিয়েই শুরু হয় দালাল চক্রের অত্যাচার। যুদ্ধের প্রশিক্ষণে যেতে সামরিক পোশাক দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ নিতে না চাইলে দেওয়া হয় হত্যার হুমকি। করা হয় মারধর, দেওয়া হয় না খাবার। পরে সোহান আকরামকে এগুলো জানায় এবং সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বলে। সোহানের দু'দিন পরে আকরামেরও যাওয়ার কথা ছিল। পরে সেখান থেকে আকরাম পালিয়ে গিয়ে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে দেড় লাখ টাকা নিয়ে টিকিট কেটে গত ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ফিরে আসে।'
সোহানের মা নূর ন্নাহারের কান্নায় আকাশ বাতাস বাড়ি হয়ে উঠছে। কতক্ষণ পর পরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি জানান, ধারদেনা করে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে তাঁর একমাত্র ছেলেকে বিদেশে পাঠানো হয়। দালাল চক্র সোহানকে রাশিয়ায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে নামিয়ে ছিল তার সন্তানকে। সংসারের একমাত্র উপার্জনশীল সোহান। তিনি বলেন, 'এখন আমি কি করবো। যুদ্ধ চলাকালে মাঝে মধ্যে তার সাথে কথা হতো, সে সারাক্ষন কান্না করতো দেশে আসার জন্য। তার বন্ধু জাফর আমাকে জানায়,সোহানের শরীলে বোমা বিস্ফোরন হলে সে মারা যায়। তার মা আরও বলেন,আমি দালালদের গ্রেপ্তারসহ বিচার চাই,আর যেন তাদের খপ্পরে পড়ে কোন মার বুক খালী না হয়। সরকারের কাছে তার ছেলের লাশ ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন তিনি।
সোহানের স্ত্রী হাবিবা আক্তার জানান, উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটছিল তাদের। সোহানকে ফিরিয়ে আনতে ড্রিম হোম ট্রাভেলসে যোগাযোগ করা হয়েছে অনেকবার। পুনরায় আড়াই লাখ টাকা নিয়ে বলেছিল জানুয়ারির ২৬ তারিখে এনে দেবে। কিন্তু আনা তো দুরের কথা এখন সে লাশ হয়ে গেলো। আমি দালালদের বিচার চাই আর আমার স্বামীর লাশ যাতে দেশে আনার ব্যবস্থা সরকার করে।
পলাশ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আবুবক্কর সিদ্দিকী বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করলে আমরা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সোহানের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্ঠা করবো। তার পরিবারের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করারও আশ্বাস দেন তিনি।