একটি প্রবাদ আছে: “বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান... এইবার ঘুঘু তোমার বধিবো পরাণ!"
বিশ্ব মোড়ল হিসেবে, “Make America Great Again” স্লোগান নিয়ে দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামরিক বিষয়ে একের পর এক সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে গোটা দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। এই অল্প সময়ে তিনি যেসব ঘটনা ঘটিয়েছেন, তা সচেতন পাঠক ও বৈশ্বিক সংবাদ পর্যবেক্ষকদের কাছে পরিচিত। তাই বিস্তারিত ব্যাখ্যার দরকার নেই।
এই সপ্তাহের শুরুতেই, আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের সূত্রে জানা যায়, আমেরিকার মৌখিক অনুমোদনে একটি বড় ঘটনা ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা ও পশ্চিমাদের কঠিন নিষেধাজ্ঞার পরেও, ইরান নিজেকে শক্তিশালী করেছে—বিশেষ করে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে, যা তারা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে ও চালিয়ে গেছে।
তবে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে, ইরান স্বেচ্ছায় পরিদর্শনের অনুমতি দেয় এবং ২০২৩ সাল থেকে সকল পারমাণবিক কর্মসূচি স্থগিত রাখে।
দুই মাস আগে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময়, সৌদি আরব ও তার মিত্রদের সহায়তায় ইরানকে একটি “পারমাণবিক স্থগিতকরণ বিল” মেনে নিতে রাজি করানো হয়, যা ৬০ দিনের মধ্যে স্বাক্ষর করার কথা ছিল।
কিন্তু সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধসহ নানা জটিল ঘটনার কারণে বিশ্বের দৃষ্টি ওই সময়সীমা থেকে সরে যায়। ঠিক সময়সীমা পার হওয়ার পর, ৬১তম দিনেই, গভীর রাতে ইরানে সক্রিয় করা হয় গুপ্তচর। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও গোপন অভিযানে ইরানের সেনাপ্রধান ও প্রধান পারমাণবিক বিজ্ঞানীসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা খুন হন। এরপর রাতের অন্ধকারে যুদ্ধবিমান ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে দিয়ে তেহরান (রাজধানী) ও পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে আক্রমণ চালায়। এই প্রথমবার, ইসরায়েল “অপারেশন রাইজিং লায়ন” নামে বিনা উস্কানিতে যুদ্ধ ঘোষণা করে, এবং ইরান ধ্বংসের হুমকি দেয় — নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে!
বছরের পর বছর ধরে নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষাকে নিশ্ছিদ্র দাবি করে ইসরায়েলিরা গর্ব করত। কিন্তু ইরানের পাল্টা আক্রমণের প্রথম রাতেই সেই গর্ব মাটিতে মিশে যায়! এরপর থেকে আর থামেনি। ইরানে ধরা পড়া গুপ্তচরদের শাস্তি, একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, তেলআবিবসহ ১৫টি শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন, সমুদ্রবন্দর, সামরিক ঘাঁটি — ইরান ব্যাপক ক্ষতি করেছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
পশ্চিমা মিডিয়া ও ইসরায়েল-সমর্থিত প্রচারযন্ত্রগুলো সত্য গোপন করলেও, “অপারেশন ট্রু প্রমিজ”-এর বাস্তব রূপ গত সাত দিনে স্পষ্ট হয়েছে। বারবার সাইরেন বেজে ওঠা, আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যাওয়া — গত ৭০ বছরে এমন ভয় ও আতঙ্ক ইসরায়েলিরা দেখেনি।
প্রথমে ট্রাম্প ও পশ্চিমা নেতারা একসঙ্গে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ইরানকে হুঁশিয়ারি দিলেও, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, তুরস্ক ও মুসলিম দেশগুলো ইরানের পক্ষে কথা বলতে শুরু করে।
অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ইরান থেকে এমন প্রচণ্ড মিসাইল হামলা দেখে সবাই স্তব্ধ! মিসাইলের সংখ্যা, শক্তি ও সঠিকতা — অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
শুরুতে ট্রাম্প ইরানকে হুমকি দিলেও, এক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়া ও সৌদি আরবের মাধ্যমে ইরানকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিতে শুরু করেন — যা উদ্বেগের ইঙ্গিত।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু চেষ্টা করছেন আমেরিকাকে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে আনতে, মার্কিন ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করে। এজন্য তিনি মার্কিন সরকার ও অর্থনীতিতে প্রভাবশালী ইসরায়েলি লবিকে কাজে লাগাচ্ছেন। তবে আমেরিকান জনসাধারণ ও সুশীল সমাজ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধ চায় না।
ইসরায়েলি মিডিয়া দাবি করছে, ইরান শিশু, নারী ও হাসপাতাল টার্গেট করছে, কিন্তু তারা সম্পূর্ণ সত্য বলছে না।
ইরান জানিয়েছে, ইসরায়েল পাল্টা বিমান হামলায় তেহরানে ৬৫০ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে।
তৃতীয় দিনে, ট্রাম্প চমকপ্রদভাবে জানালেন: ইসরায়েল চেয়েছিল ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে হত্যা করতে, কিন্তু তিনি অনুমতি দেননি। ট্রাম্প বলেন, ইরান সরকারের পতন ঘটিয়ে পুতুল সরকার বসিয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণে নেওয়াই ছিল মূল লক্ষ্য—“মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন”-এর অংশ হিসেবে।
কিন্তু সম্মানিত মুসলিম নেতা খামেনি ও যুদ্ধে অভিজ্ঞ ইরানিরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন: তারা আমেরিকার কোনো প্রস্তাব শুনবে না। ইসরায়েল, যাদের হাতে শিশু, নারী, হাসপাতাল ধ্বংস, গাজায় ত্রাণে বোমা — এমন অপরাধ বহুদিনের, তাদের বিরুদ্ধে তাঁরা ঈমান ও আল্লাহর নামে যুদ্ধ করছেন।
গতকাল ট্রাম্প যখন বললেন, "চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে দুই সপ্তাহের মধ্যে," তখন অনেকেই বুঝলেন—এটি একটি কৌশল। তবে কেউ প্রকাশ্যে বলছেন না, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অবস্থান এখন কতটা বিপদে।
আমেরিকার নিজের পক্ষে নেতানিয়াহু বা ইসরায়েলি লবির বিরুদ্ধে যাওয়া কঠিন। তাহলে দুই সপ্তাহের দেরি কেন?
ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্স ইতিমধ্যেই বুঝে গেছে—এখন সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সম্ভবত গোয়েন্দা তথ্য বা সময় এখন তাদের অনুকূলে নয়।
নির্যাতিত মুসলিমরা এখন আশাবাদী—ইসরায়েলের অস্ত্রভাণ্ডার কমে যাওয়ায়, ইরান হয়তো এবার ইসরায়েলকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারবে। ইতিমধ্যে ধনী ইসরায়েলিরা জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়ছে। যাদের উপর বহুদিন ধরে দমন-পীড়ন হয়েছে, তারা এখন প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজছে এবং প্রস্তুত হচ্ছে।
আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে ৬টি দেশে ৪০,০০০ সেনা ও ঘাঁটি স্থাপন করেছে নিজেদের স্বার্থে। দেশভিত্তিক বিভাজন কাজে লাগিয়ে বহু অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়েছে ও আধিপত্য বজায় রেখেছে।
কিন্তু ইরানের টানা আক্রমণের কারণে এবার সেই সিস্টেম ধ্বংসের মুখে। ট্রাম্পের দুই সপ্তাহ সময় নেওয়া আসলে এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে না পারারই ইঙ্গিত।
লেখক: মোঃ আসাদুজ্জামান ফারুক
২১ জুন, ২০২৫
ঢাকা
সূত্র: BBC, CNN, IRNA, BSS, AFP