ধামইরহাট (নওগাঁ) প্রতিনিধি: নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানের মধ্যে দিনদিন বেশ সুনাম অর্জন করছে নওগাঁ জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা ধামইরহাটে অবস্থিত আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান। এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে দর্শনার্থীরা এসে থাকেন দিঘীর সৌন্দর্য এবং শালবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ কাছ থেকে উপভোগ করার জন্য। বর্তমানে দিঘীর উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে, কাজ সমাপ্তি হলে দিঘীর সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বাড়বে বলে জানিয়েছেন বন কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ধামইরহাট উপজেলায় সীমান্তের কোল ঘেঁষে অবস্থিত আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান যা রাজশাহী বিভাগীয় সামাজিক বনবিভাগের আওতায়। নওগাঁ সদর এলাকা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পথ দুরে এবং পাইকবান্দা রেঞ্জের অধীনে ধামইরহাট বিটে অবস্থিত। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০১১ সালে ১৪ ডিসেম্বর মাসে আলতাদিঘীকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করেন। শালবন এবং বনভূমির মোট আয়তন ২৬৪.১২ হেক্টর। বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদে পরিপূর্ণ বনভূমির ঠিক মাঝখানে অবস্থিত প্রায় ৪৩ একর আয়তন জুড়ে সুবিশাল আলতাদিঘী। জাতীয় উদ্যানের পাশে ১৭.৩৪ হেক্টর বনভূমিকে ২০১৬ সালের ৯ জুন বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা প্রদান করেন।
স্থানীয় মানুষের মুখে একটা লোককাহিনী প্রচলিত আছে যে, প্রজা সাধারণের পানিয়জলের সংকট নিরসনকল্পে রাজা বিশ্বনাথ রাজমাতার সন্তুষ্টিকল্পে দীঘিটি খনন করা হয়। রাজমাতার শর্ত ছিল তিনি পায়ে হেঁটে যতদূর অবধি যেতে পারবেন সেই পর্যন্ত দীঘিটি খনন করতে হবে। রাজমাতার শর্ত পূরণের বিষয়ে মন্ত্রীবরের সঙ্গে রাজা পরামর্শ করে আলতা নিয়ে আসেন। অতঃপর একদিন ঘটা করে মন্ত্রীবরের সবাই রাজমাতা কে অনুসরণ করেন এবং রাজমাতা হাঁটতে শুরু করেন। কিন্তু রাজমাতার হাটা আর শেষ হয়না, তিনি হাঁটতেই থাকেন। পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে মন্ত্রীবর দীঘির শেষ প্রান্তে রাজমাতার পায়ে আলতা ছিটিয়ে দিয়ে তাকে থামিয়ে দেন বলে যে মা তোমার পা ফেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে, তুমি আর হাঁটতে পারবে না। যেই স্থানে গিয়ে রাজমাতা হাটা বন্ধ করেছিলেন শুরুর স্থান থেকে সেই অবধি পর্যন্ত রাজা বিশ্বনাথ দীঘি খনন করেছিলেন। সেই থেকেই এই দীঘিটি আলতাদীঘি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইতিহাস সম্বন্ধে সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না, তবে এই জলাশয়টি জগদ্দল মহাবিহারের সমসাময়িক অথবা পাল যুগ পূর্ববর্তী সময়ের বলে ধারণা করা যায়।
আলতাদিঘী পুনঃখনন করার নামে জীববৈচিত্র পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য দিঘীর চারদিকে কয়েক হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গাছ কাটর বিষয়ে স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ সূরক্ষা শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৬টি প্যাকেজে জিওবির অর্থায়নে সর্বমোট ১কোটি ৫৬লক্ষ ৯৬২ টাকা মূল্যে নির্মাণ কাজ চলছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দিঘীর সৌন্দর্য আরো বাড়বে বলে ধারনা করা হচ্ছে। এদিকে দিঘীর সৌন্দর্য এবং শালবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করা জন্য ১কোটি ১৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৭২০ ফিট উচু উন্নত মানের ও আধুনিক ডিজাইনে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ার থেকে দর্শনার্থীরা বন ও দিঘীর প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে প্রতিদির ভিড় করে থাকেন। তবে নতুন করে পুনঃখননে দিঘীর নিচে পানি না থাকায় কিছুটা তোপের মুখে রয়েছে সংশ্লিষ্টরা। কবে আগের মত দিঘীতে পানি জমবে আবারো সেই পরিযায়ী পাখিদের কিচিরমিচর শব্দ শুনতে পারব এমন প্রশ্ন দর্শনার্থীদের মুখে।
দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট এলাকা থেকে আসা দর্শনার্থী সাইফুল ইসলাম জানান, আমি কয়েকছর পরে এখানে পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছি। এখানে এসে নির্মিত ওয়াচ টাওয়ারে উঠেছি বেশ ভালো লেগেছে। আগের তুলনায় অনেককিছু ভালো লেগেছে দিঘীতে পানি জমলে হয়তো আর কোন দিক থেকে ঘাটতি মনে হবে না।
এ বিষয়ে বনবিট কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, আমরা দিঘীতে ঘুরতে আসা পর্যটকদের কথা ভেবে এখানে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করছি। যেহেতু দিঘী পুনঃখনন করা হয়েছে যার ফলে পানির লেয়ার জনিত সমস্যা হচ্ছে। আশা করছি ভারি বর্ষণ হলে দিঘীতে পানি জমতে শুরু করবে। দিঘীর পরিবেশ সুন্দর করতে আমরা চারদিকে প্রায় ৭ হাজার শোভাবর্ধনকারী গাছ লাগিয়েছি। আগামী ১ বছরের মধ্যে আরো সুন্দর্য বাড়াবে গাছগুলো বেড়ে উঠলে। জেলার অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে পর্যটকদের কাছে আশা করছি ভালো সাড়া ফেলবে আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান।