মো. নজরুল ইসলাম, অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি: আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। দেশ ও জাতির অবদানে প্রতিটি দেশে যেসব শিল্প গড়ে উঠেছে তাদের একটি হচ্ছে এই মৃৎশিল্প। আমাদের দেশে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। মৃৎশিল্পীগণ মাটি দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খেলনাসহ বিভিন্ন প্রকার সৌখিন দ্রব্যাদি তৈরি করে থাকেন। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় তাল মিলাতে গিয়ে স্টীল, তামা, মেলামাইন, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি নানা রকম আধুনিক সামগ্রীর প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় মৃৎশিল্পের এসব কারিগর কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তারপরও দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো তারা বাংলার এ ঐতিহ্য ধরে রেখে জীবন যুদ্ধে টিকে আছেন।
কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামের বাঙ্গালপাড়া ইউনিয়নের কুড়েরপাড় গ্রামে মৃৎশিল্পীদের ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে জীবন যাপন করছেন পাল বংশের ২২টি পরিবারের শতাধিক লোক। সম্প্রতি মাটির তৈরী তাদের জিনিসপত্রের চাহিদা কম, কাঁচামালের চড়ামূল্য ও দুষ্প্রাপ্যতা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ পুঁজির অভাবে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এ মৃৎশিল্প।
রোববার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে সরেজমিনে এ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, টিনের তৈরী ছোট ছোট ঘরের সামনের উঠানে নারী-পুরুষ অনেকেই বিভিন্ন প্রকার মাটির জিনিসপত্র তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ও অনুন্নত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত কুমার পাড়ার এসব মানুষের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ না থাকলেও তারা খুবই কর্মঠ। উঠানজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাঁদামাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কড়াই, কলস, হাতি, ঘোড়া, মাছ পুতুলসহ ছোট-বড় নানা রকমের পাত্র। এসবের কিছু কাঁচা, কিছু শুকিয়ে আবার কিছু আগুনে পুড়িয়ে রাখা হয়েছে। কেউ পুড়িয়ে রাখা এসব জিনিসপত্র রং করে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছেন।
বাড়ির উঠুনে ঢুকতেই দেখা হয় মাটির পাতিল তৈরীতে ব্যস্ত বাসন্তি রানী পালের সাথে। তিনি জানান, পুঁজি ও কাঁচা মালের স্বল্পতায় তারা এ পেশার প্রতি দিনদিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ব্যবসা মন্দার কারণে বর্তমান সভ্যতার সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে নেকেই পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন। মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তিনি সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
বাড়ির ভিতরে গেলে দেখা মেলে মৃৎশিল্পী সুকুমার পালের। তিনি বিভিন্ন প্রকার খেলনায় রঙ করছিলেন। সুকুমার পাল জানান, বাপ-দাদার এই পেশা ধরে রেখেছেন তাদের হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার। মাটি কিনে এনে এসব পণ্য তৈরি ও বিক্রি করে আমরা জীবিকা নির্বাহ করি। যুগ উপযোগী প্রশিক্ষণ ও শহজ শর্তে ঋণ পেলে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে পাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
মৃৎশিল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিলশাদ জাহান এ প্রতিনিধিকে জানান, ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সবার এগিয়ে আসা উচিত। কয়েকদিন আগে আমি এই কুমারপাড়া পরিদর্শন করে এসেছি। এ মৃৎশিল্প আধুনিকায়ন করতে, শীঘ্রই বিভিন্ন অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের জন্য ঋণ এবং বিসিকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।