ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ঝিনাইদহের ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় এখন প্রধান আলোচনার বিষয় চোরাচালান সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির দুর্বল নজরদারির কারণে ভারতীয় সীমান্ত উপজেলা মহেশপুরের গ্রামে গ্রামে বিজিবির সোর্স পরিচয়ে চোরাচালান সিন্ডিকেটের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে।
এ সিন্ডিকেট মূলত ভাড়ায় অস্ত্র ও মাদক আনা নেওয়া, সোনার বার ও মানব পাচার করে থাকে। আর এই কাজে সহযোগিতা করে বিজিবর কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও তাঁদের সোর্সরা।
বিজিবির সোর্সরা স্থানীয় ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁদের ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে চান না।
জানা গেছে, মহেশপুর ৫৮ বিজিবি ব্যাটলিয়নের অধীনে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে তাঁদের ২০ টি ক্যাম্প রয়েছে। এ সকল ক্যাম্পে কর্মরত বিজিবি সদস্যদের একাধিক সোর্স। এঁরা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে সীমান্ত এলাকায়।
বিজিবির সোর্স পরিচয় দিয়ে এ সকল ব্যক্তি এই চোরাচালান সিন্ডিকেট পরিচালনা করে বলে সরেজমিন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
সম্প্রতি ভারতীয় সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, মহেশপুরের ৯টি গ্রাম একেবারেই ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ায় সেখান দিয়ে বর্তমানে মাদক ও মানব পাচার করা হচ্ছে। গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে বাঘাডাঙ্গা, পলিয়ানপুর, যাদবপুর, জুলুলী, লেবুতলা, মরকধ্বজপুর, শ্যামকুড়, রায়পুর ও কচুয়ারপোতা। এর মধ্যে মকরধ্বজপুর, বাঘাডাঙ্গা ও রায়পুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ করানো হয়।
বাঘাডাঙ্গা ও শ্যামকুড় সীমান্ত দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র এবং লেবুতলা ও রায়পুর সীমান্ত দিয়ে সোনা পাচার করা হয়।
চলমান পরিস্থিতিতে ভিসা জটিলতার কারণে ভারতীয় সীমান্তের একদম নিকটে হওয়ায় সেখান দিয়ে অবাধে মাদক ও মানব পাচার করা হচ্ছে। বিজিবির কতিপয় আসাধু কর্মকর্তা ও তাঁদের সোর্স পরিচয় দিয়ে একাধিক ব্যক্তি ভারতীয় সীমান্তবর্তী এ এলাকাগুলোর চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রায়পুর সীমান্তে শামসুল ইসলাম কুটি মিয়া, শ্যামকুড় এলাকায় নওশের আলী, নেপা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে শমসের আলী ওরফে ভ্যাংচা ও তাঁর ছেলে এনামুল, হুদাপাড়া, কাঞ্চনপুর ও বাঘাডাঙ্গা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন আল আমিন ও জালাল হোসেন। এঁরা সবাই বিজিবির সোর্স পরিচয় দিয়ে ভারতীয় সীমান্তের এপার ও ওপার নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
বিজিবি ক্যাম্পগুলোর দায়িত্বরতরা কেউ সীমান্তের চোরাচালান নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাঁরা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দেন।
বিজিবির এসব সোর্সদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে তাঁদের সঙ্গে যোগযোগের চেষ্টা করা হলেও অধিকাংশদের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি। তবে ঝিটকিপোতা গ্রামে শমসের আলী ল্যাংচার বাড়িতে গিয়ে দেখা মিলে। তার দুইতলা বাড়ির বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত ১২ টি সিসি ক্যামের লাগানো রয়েছে। তিনি জানান, ‘বেশ কয়েক বছর আগে বিজিবর সঙ্গে যোগযোগ করে গরু পাচার করতেন। সম্প্রতি কোনো চোরচাকারবারের সাথে জড়তি নেই বলে দাবি করেনে তিনি।’
শ্যামকুড় এলাকার নওশের আলী জানান, ‘আমি হালাাল পথে আয় রোজগার করে এত সম্পদেও মালিক হয়েছি। বিজিবর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো। তবে চোরাচালান নিয়ে কোনো সম্পর্ক নেই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহেশপুর ৫৮ বিজিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিভিন্ন ক্যাম্পে কর্মরতরা যখন অধিক সময় ধরে থাকেন, তখন তাঁরা নিজস্ব সোর্স তৈরি করেন। এ সকল সোর্সদের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানের শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তাঁরা।’
তিনি আরো বলেন, ‘দেশের চলমান পরিস্থিতিতে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তবুও দেখুন আমাদের সীমান্ত দিয়ে মাদক ও মানব পাচার থেমে নেই। প্রতিনিয়ত মানব পাচার হচ্ছে। আপনারা লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত দামি দামি গাড়ি ঢুকছে সীমান্তে। এঁরা অনুপ্রবেশের জন্য আসছে। আর এদের সহযোগিতা করছে আমাদের কতিপয় অসাধু সদস্য ও তাঁদের সোর্সরা।’
স্থানীয় নেপা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামছুল ইসলাম মৃধা বলেন, ‘বিজিবির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও তাঁদের সোর্সরা আমাদের সীমান্তে যখন যা ইচ্ছে তখন তাই করে। আমরা এ নিয়ে একাধিকবার প্রতিবাদ করেও কোনো ফল পাইনি। এর আগে একবার আমি জেলা মাসিক সমন্বয় সভায় বিষয়টি তুলেছিলাম। বিজিবসহ তাঁদের সোর্সদের বিরুদ্ধে নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। নইলে তাঁদের অপকর্মের জন্য আমাদের এই এলাকার ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হবে।’
এ সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে মহেশপুর ৫৮ বিজিবির অধিনায়ক কর্ণেল শাহ্ মো. আজিজুস শহীদের ব্যবহৃত মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি তাঁর কার্যালয়ে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘আগামী সভায় এ নিয়ে আলোচনা করা হবে।’