ঢাকা
১৫ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রাত ১০:০১
logo
প্রকাশিত : এপ্রিল ৭, ২০২৫

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন; সামরিক জান্তার ওপর নির্ভর করছে

প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের যোগ্য হিসাবে চিহ্নিত করলেও তাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ভেরিফিকেশন তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে না। তাদের রেসিডেন্সি নিশ্চিত করে। রোহিঙ্গারা তাদের মূল আবাসভূমিতে নাগরিক হিসাবে ফিরতে চায়। কিন্তু মিয়ানমার তাদের অন্য জায়গায় রাখতে চায়। ফলে এর আগে তিনবার তাদের প্রত্যাবাসন চেষ্টা সফল হয়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভেরিফিকেশন অনেক দিন ধরেই চলছে। বাংলাদেশ থেকে ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ জন রোহিঙ্গার তালিকা ২০১৮ সালেই পাঠানো হয়েছে। তখন তারা ৩৭ হাজার ৭০০ জন রোহিঙ্গা যে মিয়ানমারের বসিন্দা তা নিশ্চিত করেছিলো। তারপর ১ লাখের। এবার তারা ১ লাখ ৮০ হাজারের ভেরিফিকেশনের কথা বলছে।

শুক্রবার ব্যাংককে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে এক বৈঠকে মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউ বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমাকে জানান বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের যোগ্য (ভেরিফাই) হিসাবে চিহ্নিত করেছে মিয়ানমার। বৈঠকের এই তথ্য জানান ড. খলিলুর রহমান নিজেই।

প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে জানায়, রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের দিকে এটি একটি বড় ও নিশ্চিত পদক্ষেপ।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালে এই ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দুইবার তাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ সফল হয়নি। সবশেষ ২০২৩ সালে তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল না হওয়ার কারণ হলো রোহিঙ্গারা বলেছিলো তারা তাদের প্লেস অব অরিজিনে ফেরত যেতে চায়। তারা যে জায়গা থেকে বাস্তুচ্যূত হয়েছে সেই জায়গায় ফেরত যেতে চায়। কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। এছাড়া আরো কারণ আছে। তাদের নিরাপত্তার দাবি আছে। নাগরিকত্বের বিষয় আছে। কারণ মিয়ানমার তো তাদের নাগরিক বলছে না। তারা যে সেখানে ছিলো সেটা বলছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন যে ১ লাখ ৮০ হাজারের কথা বলা হচ্ছে আমার মনে হয় এখন পর্যন্ত যাদের ভেরিভিকশন শেষ হয়েছে এটা তাদের সংখ্যা। তবে আমরা এখনো কাগজপত্র পাইনি।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বলেন, আসলে এটা নির্ভর করছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ওপর। তারা চাইলেই আমরা ফেরত পাঠানোর জন্য প্রস্তুত আছি। আর রোহিঙ্গারাও তাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে চান। কিন্তু যে কারণে তাদের চলে আসতে হয়েছে সেই কারণ যদি বর্তমান থাকে তাহলে সেটা কীভাবে সম্ভব। তারা তো চায় নাগরিক হিসাবে আত্ম মর্যাদা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে সেখানে ফিরতে।

এদিকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া শীর্ষ রোহিঙ্গা নেতাদের একজন মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, বাংলাদেশ সরকার আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে। এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ভেরিফাই করতে মিয়ানমারের ৮ বছর লেগেছে। রোহিঙ্গা আছে ১২ লাখ। সবাইকে ভেরিফাই করতে তাহলে ৪০ বছর লাগবে। আর ভৈরিফাই করার প্রশ্ন কেন। আমরা তো রোহিঙ্গা, মিয়ানমারের নাগরিক। আমরা পূর্ণ নিরাপত্তা নিয়ে নাগরিক হিসাবে আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে চাই। সেখানে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সেফ জোন করে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, মিয়ানমার জান্তার এই ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। তারা বাংলাদেশ সরকারের সাথে নতুন প্রতারণা শুরু করেছে।

রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, আসলে মিয়ানমারের জান্তাদের কিছু কৌশল আছে। এখন সেখানে একটা ভূমিকম্প হয়েছে। বাংলাদেশ উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছে। জান্তাদের বিরুদ্ধে জোনোসাইডের অভিযোগ আছে। তারা একটা কৌশল নিচ্ছে। এর আগে তারা ভেরিফিকেশনের কথা বলেছে। আসলে দরকার রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে সম্মানজনক প্রত্যাবাসন। তার কোনো প্রক্রিয়া এখনো দেখা যায়নি। আসলে এটা করতে হবে সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে।

মিয়ামারের সিতোয়ে মিশনে বাংলাদেশের সাবেক হেড অব মিশন মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, আসলে ওখানে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর আর নাই। তা আগেই গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর এখন প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা আরাকান আর্মির দখলে। তাহলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কোথায় হবে? এর আগেও ভেরিফিকেশনের কথা বলে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমার তাদের বানানো ক্যাম্পে রাখতে চেয়েছিলো। সেখানে তারা নগরিক অধিকার পাবে না। তারা তো রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।

তিনি বলেন, আসলে তাদের বাড়িঘর, জমি, তাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্বসহ আরও অনেক বিষয় এখানে জড়িত। মিয়ানমার জান্তা আসলে নতুন কৌশল নিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া নয়। আর আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিয়ানমারের হয়ে কিছু রোহিঙ্গা যুদ্ধ করেছে। সেটাকে আরকান আর্মি কীভাবে নেবে সেটাও একটা প্রশ্ন। রাখাইনে তো আর মিয়ানমার জান্তার এখন দখল নেই।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের এক কর্মকর্তা ডিডাব্লিউকে বলেন, এর আগে যাদের ভেরিফিকেশন করা হয় তাতে ব্যাপক জটিলতা ছিলো। দেখা গেছে এক পরিবারের চার সদস্যের দুই জনকে ভেরিফাই করা হয়েছে দুই জনকে করা হয়নি। আবার এক পরিবারের একজনকে সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটাও মিয়ানমারের একটা অপকৌশল। এবারও সেরকম করা হয়েছে কী না, তা তালিকা পেলে দেখা যাবে। আসলে ভেরিফিকেশনের নামে পরিবারকে আলাদা করা, এক পাড়ার লোককে আলাদা করা- এই সব কৌশল নেয় তারা।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার এক ফেসবুক পোস্টে বলেছেন,আগামী বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠাতে পারবো কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। আমাদের চাপ সৃষ্টি করে যেতে হবে যাতে তারা স্বেচ্ছায়, পূর্ণ মর্যাদা ও নিরাপত্তার সাথে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়।

তিনি বলেন, বার্মিজ সামরিক জান্তাকে খুশি করার জন্য তথাকথিত ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’র ঘনিষ্ঠ চাটুকার ও কিছু কূটনীতিক রোহিঙ্গাদের জন্য এক নতুন নাম তৈরি করেছিলেন- এফডিএমএন , অর্থাৎ ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যূত মিয়ানমার নাগরিক’। এই শব্দটি আসলে বার্মিজ গণহত্যার মূল আখ্যানকে মেনে নেয়ার একটি কৌশল, যেখানে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বই অস্বীকার করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রোহিঙ্গারা কোনো এফডিএমএন নয়- তারা শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাস, শিল্প ও সংস্কৃতির ধারক একটি জাতি। এফডিএমএন শব্দটি ব্যবহার করে তাদের প্রকৃত পরিচয়, সম্মান ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রেস সচিব আরও বলেন, চীনের কুনমিং শহরে এবং ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে আলোচনা করে, তখন তারা দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার জনগোষ্ঠীকে তাদের প্রকৃত পরিচয়ে পরিচিত করে ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে। জান্তার কর্মকর্তারাও শেষমেশ এই পরিচয় স্বীকার করতে বাধ্য হন। আমাদের সঙ্গে বৈঠকে তারাও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেন। আমি নিজে ওই দুটি বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম।

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না যে আগামী বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠাতে পারব কিনা। বিশেষ করে রাখাইনে আরাকান আর্মির (এএ) দখল প্রক্রিয়ার ফলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। তবে গত কয়েকদিনে যেটা দেখেছি, তা আমাদের নেতৃত্ব এবং শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিকদের এক সাহসী ও দৃঢ় অবস্থান। মিয়ানমার জান্তা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছে। এখন দরকার টানা কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখা, যাতে তারা রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, পূর্ণ মর্যাদা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তার সঙ্গে ফিরিয়ে নেয়।

শফিকুল আলমের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি তারা ফেসবুক পোস্টে দেয়া বক্তব্যেরই পুনরুল্লেখ করেন।

সূত্র: ডয়েচে ভেলে (ডিডব্লিউ)।

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram