প্রদীপ কুমার দেবনাথ, বেলাব (নরসিংদী) প্রতিনিধি: মৃৎশিল্প আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং গ্রামীণ শিল্পের এক অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সুদীর্ঘকাল ধরে এ শিল্পটি শুধু সৌন্দর্য নয় মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও জীবিকার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। এটি একদিকে আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে করেছে সমৃদ্ধ, অন্যদিকে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব নিরসনের উপায় হিসেবে কাজ করছে। মৃৎশিল্পীদের তৈরিকৃত উপকরণগুলো একসময় মানুষের অপরিহার্য উপাদান ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক পরিবর্তন, কালের পরিক্রমা আর মানুষের পরিবর্তিত চাহিদার যাতাকলে হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের এ শিল্পটি এখন বিলুপ্ত হওয়ার পথে।
খুব বেশিদিন আগে নয়, মাত্র পঁচিশ-ছাব্বিস বছর পূর্বে মানুষের ঘরে ঘরে শোভা পেত মাটির তৈরি হরেক রকমের বাসনকোসন, হাড়ি পাতিল, রঙবেরঙের শখের জিনিস। মানুষ রান্নাবান্না, খাবারদাবার, ঘরের সৌন্দর্যবর্ধনে মাটির তৈরি উপকরণে সুসজ্জিত করতো তাদের গৃহ। তাছাড়া এসব মৃৎশিল্পের চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া। ব্যাপক চাহিদা আর ভাল দাম পাওয়ার কারণে কুমোরপাড়া ব্যস্ত থাকতো একের পর এক নতুন, আকর্ষণীয় ও পছন্দসই উপকরণ তৈরিতে। এ সময় কুমোর পাড়ায় ভীড় জমতো নারী ও শিশুদের তাদের শখের জিনিস অর্ডার দিয়ে তৈরি করে নিতে। বিশেষ করে বৈশাখী মেলা, গ্রাম্য মেলা ও হাটবারের আগের রাতগুলো নির্ঘুম কাটতো মৃৎশিল্পীদের। শুধু গ্রামগঞ্জে নয় শহরের সৌখিন মানুষেরা এগুলো সংগ্রহ করতো এবং তাদের বাড়িঘরে সাজিয়ে রাখতো। ভালো বেচাকেনা থাকায় মৃৎশিল্পীরা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতো।
কিন্তু কালের পরিক্রমায় মাটির বাসন, হাঁড়ি পাতিল, কলস, খেলনাসহ নানা উপকরণের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। প্লাস্টিক ও এ্যালুমিনিয়াম সামগ্রী দখল করে নিয়েছে ঐতিহ্যের মৃৎশিল্পের বাজার। কদর কমে যাওয়ায় হাজার হাজার মৃৎশিল্পী এখন অভাব অনটন আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উৎকন্ঠায় কাটাচ্ছে দিন। মাটির পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় মৃৎশিল্পীরা তাদের তৈরি করা জিনিসগুলো বিক্রি করতে পারছেনা না। আর নামমাত্র মূল্যে যদিও বিক্রি হচ্ছে এতে তাদের সংসারের চাহিদা মিটেছে না। ফলে অনাহারে, অর্ধাহারে, অসুখ বিসুখে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অনেক পরিবার। কিছু কিছু লোক পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় গেলেও অধিকাংশই এখনও বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে খেয়ে না খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে।
সম্প্রতি নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার সুটুরিয়া গ্রামে অবস্থিত কুমোর পাড়ায় সরেজমিনে মৃৎশিল্পীদের জীবনধারা প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে তাদের দৈন্যদশা চোখে পড়ে। এ সময় প্রায় সত্তর বছরের বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী ধীরেন্দ্র পাল জানায়, বাপ-দাদার পেশা ছাড়ুম কোমনে? অনেক কষ্টে খেয়ে না খেয়ে দিন চললেও আমৃত্যু এ পেশায়ই থাকতে চাই। সরকার আমাগোর দিকে চাইলে আমরা কষ্ট থেকে মুক্তি পেতাম। এ সময় আরেক বয়োবৃদ্ধ মৃৎশিল্পী বলেন, এহনও শহরের সাবেরা আমাগোর পোড়ামাটির জিনিসপত্র পছন্দ করে। কিন্তু, নানা কারণে তাগোর চাওয়ামতো পছন্দের জিনিস দিতে পারিনা। আমগোরে সরকার একটু সাহায্য করলে আর সবাই আন্তরিক অইলে আমরা আবার আগের মতো সুন্দর সুন্দর জিনিস উপহার দিতে পারতাম।
তাদের মতোই এই পাড়ার নারী-পুরুষের দাবি প্রশাসনের উদ্যোগে মৃৎশিল্পের মেলা, প্রচার প্রচারণা ও সরকারি সাহায্য সহযোগিতা পেলে এই শিল্পটি আগের জৌলুশ ফিরে পেত এবং অনেক বেকারত্ব লাঘব হতো।