সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডির নির্বাহী পরিচালক সাংবাদিক জিল্লুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কবে হবে? এই প্রশ্ন এখন যেন সময় পরিস্থিতি এবং শর্তের ওপর নির্ভর করে। লন্ডনে অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠকের পর এক যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, আগামী বছরের রমজান শুরুর আগেই অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু ঘোষণা এবং বাস্তবতা কিন্তু এক নয়। নির্বাচনের এই সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে যেমন আসার আবহ তৈরি হয়েছে, তেমনি একে ঘিরে শুরু হয়েছে সন্দেহ প্রশ্ন এবং কুটচাল।
নিজের ইউটিউব চ্যানেলে সমসাময়িক রাজনীতি ও নির্বাচন প্রসঙ্গে এসব কথা বলেন তিনি।
জিল্লুর রহমান বলেন, প্রথমত এই ঘোষণায় বলা হয়েছে ‘নির্বাচন হতে পারে’। অর্থাৎ এটি একটি সম্ভাবনার দিক নির্দেশ নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নয়। প্রধান উপদেষ্টা নিজেও নির্বাচন কমিশনের নির্দিষ্ট ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জানিয়েছেন, তফসিল ঘোষণা বা নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করা কমিশনের দায়িত্ব।
সুতরাং রাজনৈতিক ঐকমত্ব থাকলেও প্রশাসনিক প্রস্তুতি আইনগত বাধ্যবাধকতা এবং নির্বাচনপূর্ব সংস্কার বিচার সবকিছুর নির্যাস মিললেই কেবল ভোটের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ সামনে আসবে।
তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূসের সাম্প্রতিক লন্ডন সফরে আরেকটি দিক আলোচনা এসেছে। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। বরং গণমাধ্যমের টিউলিপ সিদ্দিকের অভিযোগ ইউনূস রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে তার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছেন।
এই ব্যাখ্যা প্রতিব্যাখ্যার মাঝেই ইউনূস বিবিসির এক সাক্ষাৎকারের সাহায্য কমে যাওয়ার প্রসঙ্গে বলেন—সহায়তা না পেলেও বাংলাদেশ নিজের চেষ্টায় পরিস্থিতি সামলাবে। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি স্বীকার করেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধ হওয়া একটি গুরুতর সংকট। প্রশ্ন উঠে, এই সংকট ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মাঝে সরকার কীভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব ও গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা পূরণ করবে।
তিনি আরো বলেন, লন্ডন বৈঠকের পর বিএনপির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও, তাতে কতটা স্থায়িত্ব আছে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। কারণ ফেব্রুয়ারিতে ভোট আয়োজনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে একাধিক শর্ত।
সংস্কার ও বিচারের ক্ষেত্রে ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’। ‘সকল প্রস্তুতির সমাপ্তি’ ইত্যাদি। কিন্তু কী সেই ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’। বিচার বলতে কি অভিযোগপত্র চার্জ গঠন নাকি রায়? এত সংখ্যক মামলা, এত শত আসামি—এগুলো বাস্তবে কীভাবে ফেব্রুয়ারির আগে নিষ্পত্তি সম্ভব?
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি তদন্তের দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস সামনে রেখে এই শর্তগুলো অনেকের কাছেই কৌশলি জটিলতাবলি প্রতীয়মান। আর এখানেই অনেকে মনে করছেন সরকার একটি রাজনৈতিক বল ঠেলার খেলা খেলছে। দায়টা বিএনপির কাছে চাপিয়ে রেখে। অর্থাৎ ভোট চাইলে সংস্কারের সহযোগিতা করো। আর দেরি হলে দায় তোমার। এই অবস্থানে বিএনপি যদি সংস্কার নিয়ে দ্বিধায় থাকে কিংবা জুলাই সনদ নিয়ে আপত্তি তোলে তাহলে, ভোট পিছে যাওয়ার দায়ও তাদের ঘাড়ে যাবে। এটা এক ধরনের রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ, যা গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা সংহত করার চেষ্টা বলেই ব্যাখ্যা করছেন বিশ্লেষকরা। তারপর আবার এসছে এনসিপির খোঁচা। এই দলটি এখনো নিবন্ধিত না হলেও সরকারের অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রধান আশ্রয়দাতা বলেই পরিচিত। তারা স্পষ্ট করে বলছে—জুলাই সনদ ছাড়া নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
জিল্লুর রহমান বলেন, এনসিপি মনে করছে, সংস্কার ও বিচারের রোডম্যাপ ছাড়া ফেব্রুয়ারির ভোট মানে হবে, এক ধাপ এগিয়ে দু-ধাপ পেছানো। আর তারা যতটানা নির্বাচনের পক্ষে তার চেয়ে বেশি একটি কাঠামোগত রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার পক্ষপাতী। তাদের বক্তব্য স্পষ্ট, নতুন সরকার যদি পুরনো ধারার লুটপাট, দলীয়করণ আর ক্ষমতার বলই ফিরে যায়, তাহলে জনগণের রক্ত ও ত্যাগ বৃথা যাবে। তবে এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, এনসিপির গত কয়েক মাসের কর্মকাণ্ড যে অভিযোগগুলো তারা অন্যদের ওপরে আনছে, যে আশঙ্কা তারা করছে, সেসব অপকর্মের চর্চার সঙ্গে তাদের অনেকেই জড়িয়ে পড়েছে। সেখানে নৈতিক শৃঙ্খলার অভাব, সেখানে দুর্নীতির অভিযোগ, সেখানে চাঁদাবাজির অভিযোগ এগুলো তাদের বিরুদ্ধে নানাভাবে নানা মহল থেকে তোলা হয়েছে। এই রাজনৈতিক গোলকধাঁধার মধ্যে জড়িয়েছে একটি নতুন ভূরাজনৈতিক মাত্রা চীন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্প্রতি পুর্মিং এ একটি ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা প্লটফর্ম গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশ-চীনের প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরো বলেন, ইউনান প্রদেশের পুর্মিং বৈঠকে তিন দেশের কর্মকর্তারা বহুমুখী সহযোগিতার বিষয়ে ঐক্যমত পৌঁছেছেন। যদিও বাংলাদেশের তরফ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি… যখন বলা হয়েছিল শুরুতে আসেনি। কিন্তু পরে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এই বিষয়ে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। চীন এবং পাকিস্তান তাদের অবস্থান কিন্তু দ্রুততার সঙ্গে স্পষ্ট করেছে। আমরা এটাও জেনেছি যে এই উদ্যোগের পেছনে মূল ভূমিকাটা পালন করেছে চীন। এই জোট গঠনের পেছনে যে বড় কূটনৈতিক অভিসন্ধি আছে, তা বলাই বাহুল্য। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কৌশলগত প্রভাবকে প্রতিহত করবার চিন্তা চীনের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষণ। আর সেই জায়গায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে এক ছাতার নিচে আনার প্রয়াস তাদের বহুদিনের।
এই সাংবাদিক বলেন, এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শুধু ভারতের দৃষ্টিতে একটু রোষানলে পড়বে না। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এই প্রক্রিয়ায় বা এই উদ্যোগে অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে। অসন্তুষ্ট হতে পারে। এতে অবশ্যই অনেকেই মনে করতে পারেন তাতে আমাদের কি যায় আসে। ভারত আমাদের এত এত ক্ষতি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য কিছুই করেনি। এগুলো বলবার জন্য অনেকেই বলতে পারেন। আমি জাস্ট কথাটা বলে রাখতাম। আর এর বাইরেও আমরা নানা রকমের উদ্যোগ এর আগে দেখেছি। বিসিআইএম এর উদ্যোগ আমরা দেখেছি। সেগুলো খুব একটা কাজে করেছে, আমরা দেখিনি। অবশ্যই সেগুলোর মধ্যে ইন্ডিয়া ছিল এবং সেখান থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন পাকিস্তান এবং চীনের সঙ্গে এই ট্রাইল্যাটারাল মেকানিজমের মধ্যে ঢুকলো। এই প্রেক্ষাপটে আবার প্রশ্ন আসে যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কি ধীরে ধীরে ভারত ঘেঁষা নীতিকে সরিয়ে একটি ভিন্ন ধারার ভূরাজনৈতিক বা ভুরাজনীতিতে ঢুকে পড়ছে?
তিনি বলেন, ইউনেসের বেইজিং সফর চীনা বিনিয়োগে আগ্রহ তিস্তা প্রকল্প নিয়ে নতুন চুক্তির সম্ভাবনা সবই এর ইঙ্গিতবাহী। আর পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক শীতলতা ভেঙে আবার সম্পর্ক জোরদার করাও একই কৌশলের অংশ। একদা ভারত নির্ভর পররাষ্ট্রনীতিকে এখন চীনা ছত্রছায়ায় ঢুকে পড়ছে? এই প্রশ্ন তুললে বেশি অত্যুক্তি হবে না। ভারত যে এতে স্বস্তি পাচ্ছে না তা স্পষ্ট। চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ জোটের প্রভাবিত অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর বেশ কিছু ভারতের সংবেদনশীল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত ঘেঁষা অঞ্চলে। ফলে বেইজিংয়ের এই কূটনৈতিক তৎপরতা নয়া দিল্লির নিরাপত্তা চিন্তায় বড়সড় ধাক্কা দিতে পারে। আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যদি চীন ও পাকিস্তানের প্রভাব বাড়তে থাকে, তাহলে তা ভারতের জন্য কৌশলগত অসন্তোষের নতুন কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
জিল্লুর রহমান বলেন, সবকিছু মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক ইফেক্ট নয়। এটি একটি বৃহত্তর কূটনৈতিক খেলার অংশ। একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণ প্রক্রিয়ার অনিশ্চিত অধ্যায় এবং জনগণের বহু বছরের অধিকার ফিরে পাওয়ার আশা ও হতাশার সম্মেলন। এখানে সময়ের গুরুত্ব যেমন আছে, তেমনি আছে শর্তের পাহাড়। আছে দলীয় অবস্থানের জটিলতা, গণতান্ত্রিক সংস্কার নিয়ে অমীমাংশিত বিতর্ক এবং বিচার প্রক্রিয়ার ধীর গতি। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির ভোট এখনো একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। এটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে চাই স্পষ্ট রোডম্যাপ। আইনি নিশ্চয়তা এবং জাতীয় ঐক্যমত। আর চাই এমন এক রাজনৈতিক সদিচ্ছা যেখানে নির্বাচনের আগে নয় নির্বাচনের পরেও জনগণের অধিকার এবং ন্যায়বিচারকে প্রতিষ্ঠা করা হবে। যদি তা না হয়, তাহলে একটি দিনের ভোট শুধুই ক্ষমতার পালাবদল হবে। গণতন্ত্রের নয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন একটাই মানুষ কি কেবল একজন শাসকের পতন চেয়েছিল নাকি তারা রাষ্ট্রের নতুন জন্ম চেয়েছিল এই প্রশ্নের উত্তরেই নিহিত আছে ফেব্রুয়ারির ভোটের ভবিষ্যৎ। অবশ্য একথাও বলতে হবে রাষ্ট্রের নতুন জন্ম মানেই ৭১ এর জন্মকে অস্বীকার করে নয় এবং ৭১ এর জন্মই হচ্ছে মূল জন্ম। নতুন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় বাংলাদেশ এগুলো বলবার মধ্যে অনেক সময় ৭১ অস্বীকার করবার প্রবণতা আছে সেটা কিন্তু একেবারেই নয়।