অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘ছুটির উৎসব’ সংস্কৃতি, অতীতের যে-কোনো সরকারের ছুটির সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে গেছে। তারা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছুটির সিদ্ধান্ত— এক ধরনের উৎসবে রূপ নিয়েছে। ছুটি যেনো তাদের কাছে সুশাসনের বিকল্প বন্দোবস্ত। যেকোনো অজুহাতে রাষ্ট্রকে দীর্ঘ ছুটির ঘুমে পাঠাতে পারা যেনো—সাফল্যের সোপান। টানা দশদিন ছুটি'র অত্যুৎসাহী এই আদেশ—অনৈতিক এবং কোনোভাবেই তা জনস্বার্থ রক্ষা করে না। দীর্ঘ ছুটি কখনোই প্রশাসনিক উদারতা নয় বরং এটি রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি—আস্থা, দায়িত্ববোধ এবং সেবাদানের অঙ্গীকারে ঘাটতির প্রতীক।
বিশ্বের কোথাও কোনো দিবসকে কেন্দ্র করে দীর্ঘস্থায়ী রাষ্ট্রীয় ছুটি দেওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশে ‘বিরল’ এই ছুটি দিয়ে সরকার মনে হয় মহৎ কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাচ্ছে। সাধারণভাবে, ধর্মীয় বা জাতীয় উৎসব উপলক্ষ্যে উৎসবের আগের দিন, মূল দিন ও পরদিন—এই তিনদিনের ছুটি একটি প্রতিষ্ঠিত নীতি। তবে প্রশ্ন হলো, এই তিন দিনের ছুটি কীভাবে এক লাফে দশ দিনে পরিণত হলো? সরকার কি কোনো প্রচলিত আইন, প্রথা বা নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে?
অথচ এই সময়ের মধ্যেই শনিবার অফিস খোলা রাখা হয়েছে। তাহলে কি দেশে জরুরি অবস্থা চলছে কিংবা রাষ্ট্র কোনো জরুরি অবস্থার দ্বারপ্রান্তে? সরকার কি বছরের নির্ধারিত সাপ্তাহিক ছুটিগুলোকে ইচ্ছেমতো পুনর্বিন্যাস করে দীর্ঘমেয়াদি একটানা ছুটিতে নিয়ে যেতে পারে? সাপ্তাহিক ছুটির আগে-পিছের দিনগুলোতে অফিস খোলা রাখার মূল যুক্তি হলো—রাষ্ট্রের জনগণই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।
রাষ্ট্র কেবল কাগুজে ঘোষণা বা আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়—এটি একটি বাস্তব ও জীবন্ত প্রতিষ্ঠান। যার অস্তিত্বের ভিত্তি জনগণের সেবা নিশ্চিত করার নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় নিহিত। রাষ্ট্র কারো ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান নয় যে, ইচ্ছেমতো তাকে বন্ধ করে দেওয়া যাবে বা ছুটি বাড়ানো যাবে।
সম্প্রতি দশ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো—সরকার কি নিজ দায়িত্বে ছুটি নিতে পারে? কিংবা রাষ্ট্রকে ছুটির ফাঁদে ফেলা যায়? সরকার যদি দীর্ঘমেয়াদে ছুটি ঘোষণা করে এবং তার ফলে জনজীবনে অনিশ্চয়তা, বিশৃঙ্খলা, আর্থিক লেনদেন বা জরুরি সেবাগুলো ভেঙে পড়ে, তাহলে তা রাষ্ট্রের নৈতিক ব্যর্থতার উদাহরণ হবে।
সরকারি কর্মচারীরা যদি নির্ধারিত ছুটির সঙ্গে ঐচ্ছিকছুটি এবং প্রাপ্যছুটি যোগ করে আরও দীর্ঘস্থায়ী ছুটি উপভোগ করতে চায়, তাহলে রাষ্ট্রের অবস্থা কী দাঁড়াবে?
ঈদের আনন্দ যদি রাষ্ট্রীয় ছুটির দীর্ঘ উৎসবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তবে খাদ্যসঙ্কটে থাকা অসংখ্য নাগরিকের খাদ্যঝুঁকিকে আরও প্রকট করে তুলবে। এ ছাড়াও অনাবশ্যক এই দীর্ঘছুটি— উৎপাদনশীলতা, অর্থনীতি এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল মানুষের বিপর্যয় হতে পারে এবং তা
জনজীবনে বিশৃঙ্খলা আনতে পারে—এসব প্রশ্ন সরকারের বিবেচনায় নেই কিংবা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। শুধু রাস্তাঘাট ঝামেলা মুক্ত হবে আর এতে সরকারের কৃতিত্ব বাড়বে—এটাই ছুটির মুখ্য উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। আশ্চর্যের বিষয় হলো—যে ছুটির মধ্যে রাষ্ট্র এবং জনগণের অধিকার ও সুরক্ষা প্রাধান্য পায়নি—সে ছুটিতে সরকার লজ্জিত হচ্ছে না বরং গর্ব অনুভব করছে!
সরকারি ছুটির তাৎপর্য বহুস্তরীয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্র-কাঠামোর সঙ্গে তা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। নিম্নে এ সম্পর্কে বিশ্লেষণসহ কয়েকটি বিষয়ের উপর দৃষ্টিপাত করা হলো:—
১. শ্রমিকের বিশ্রাম ও পুনর্জাগরণ: সরকারি ছুটি কর্মজীবী মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। এটি কর্মীদের ক্লান্তি দূর করে, নতুন উদ্যমে কাজের জন্য প্রস্তুত করে।
২. সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনের সুযোগ: ছুটির দিনগুলো পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ এনে দেয়। এতে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় এবং সামাজিক সম্প্রীতির বিকাশ ঘটে।
৩. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ: ঈদ, পূজা, বড়দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা ইত্যাদি উপলক্ষ্যে ছুটি দিয়ে রাষ্ট্র ধর্মীয় সহনশীলতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেয়।
৪. জাতীয় ইতিহাস ও চেতনার স্মরণ: স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি স্মরণে জাতির ইতিহাস ও সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এতে জাতীয় চেতনা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়।
৫. রাষ্ট্রীয় নীতি ও নৈতিকতা: ছুটি কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে, তার মধ্যেই রাষ্ট্রের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়।
একটি ধর্মীয় উৎসবে যদি দশদিনের ছুটি দেওয়া হয়, তবে বিভিন্ন পূজা, বড়দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমায়ও একই ছুটি দিতে হবে, না হলে তা বৈষম্য সৃষ্টি করবে। ছুটির সমতা নিশ্চিত না করলে এটি ধর্মীয় বা সামাজিক বিভেদের কারণও হতে পারে। সরকার এসব প্রশ্নে উদাসীন।
দার্শনিক বিশ্লেষণ:
অ্যারিস্টটলের মতে—প্রকৃত নেতার মধ্যে থাকা উচিত "Practical wisdom" (Phronesis)—যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও নৈতিক বিবেচনার সমন্বয়।
হান্না আরেন্ট রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা বা অতি-আমলাতান্ত্রিকতা বুঝাতে “Banality of irresponsibility” শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। সিদ্ধান্তের মধ্যে নৈতিকতা না থাকলে তা পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিষ্ঠুর ও দায়িত্বহীন করে তোলে।
মিশেল ফুকো শাসনক্ষমতাকে শুধু আইন বা শক্তির মাধ্যমে নয় বরং সময়, কাজ ও জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও বিশ্লেষণ করেছেন। সরকার যদি দীর্ঘছুটির সিদ্ধান্ত নিয়ে নাগরিকের জীবনযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করে, তবে তা একরকম কর্তৃত্ববাদী “Bio-politics”-এর প্রকাশ।
সরকারি ছুটি শুধুই বিশ্রামের সুযোগ নয়—এটি রাষ্ট্রীয় নীতি, জাতীয় ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও মানবিক মর্যাদার বহুমাত্রিক প্রতিফলন।
রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হলো নাগরিকের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং মৌলিক সেবা নিশ্চিত করা—এই দায়িত্ব অস্থায়ী নয়, ধারাবাহিক ও বিরতিহীন।
স্বাস্থ্যখাত, আদালত, প্রশাসন—সব ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদি ছুটি দিলে রাষ্ট্র কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এই নিষ্ক্রিয়তা কেবল অব্যবস্থার জন্ম দেয় না, নাগরিক অধিকারও হুমকির মুখে পড়ে। কোনো অভিযুক্ত আদালত থেকে জামিন পেলেও ছুটির কারণে যদি তাকে অতিরিক্ত সাতদিন জেলখানায় থাকতে হয়—এই অন্যায়ের দায় কে নেবে?
প্রাইমারি স্কুলে দীর্ঘছুটির যুক্তি—শিশুর মানসিক বিকাশ কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য এই যুক্তি প্রযোজ্য নয়। রাষ্ট্র একটি চিরসচল, সক্রিয় ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান।
জন রলস বলেছেন— “ন্যায়বিচার হলো সমাজের প্রথম গুণ।” হান্না আরেন্ট রাষ্ট্রে জনগণের অংশগ্রহণ ও দায়বদ্ধতাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। যদি রাষ্ট্র নিজেই দায়িত্ব পালন থেকে ছুটি নিতে চায়, তবে নাগরিকগণ জবাবদিহিতা চাইবে কার কাছে?
এ ধরনের ছুটি কেবল প্রশাসনিক স্থবিরতা সৃষ্টি করে না বরং রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থাও দুর্বল করে। যে-রাষ্ট্র নাগরিকের জরুরি প্রয়োজনে সাড়া দিতে পারে না, সে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিক কেন আনুগত্য পোষণ করবে?
সরকারের উচিত—অপরিণামদর্শী ছুটির সংস্কৃতি পুনর্মূল্যায়ন করা। উৎসব উদযাপিত হবে, ছুটিও থাকবে কিন্তু তা যেনো দীর্ঘমেয়াদি হয়ে রাষ্ট্রকে ক্লান্ত করে না ফেলে। রাষ্ট্র একটি নাগরিক চুক্তিভিত্তিক সত্তা, যা নাগরিকের জীবনযাত্রা ও অধিকার রক্ষায় প্রতিমুহূর্তে সক্রিয় থাকবে।
অতিরিক্ত ছুটির প্রতিটি দিন যেনো কারো না কারো জন্য ন্যায়, সেবা ও মর্যাদাবোধ থেকে বঞ্চিত হবার প্রতীক না হয়ে দাঁড়ায়—এই সতর্কতা রাষ্ট্রের গ্রহণ করা উচিত। দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায়, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং জনদুর্ভোগের প্রেক্ষিতে এই দীর্ঘছুটি রাষ্ট্রকে সচল না রেখে—ছুটির নামে স্থবির করে দেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছুই নয়।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: faraizees@gmail.com