

পাকিস্তান যেন আবার ভূ-রাজনীতির হাওয়া ঠিকঠাক ধরতে পেরেছে। গত মাসে দেশটি সৌদি আরবের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই সাহসী চুক্তি অনুযায়ী, এক দেশের ওপর আক্রমণ অন্য দেশের ওপর আক্রমণ বলে গণ্য হবে -এমন এক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, যা মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অঞ্চলে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। একই সময়ে ইসলামাবাদ নীরবে যুক্তরাষ্ট্রে বিরল খনিজের নমুনা পাঠিয়েছে এবং গভীরতর রপ্তানি চুক্তির বিষয়েও আলোচনা করছে। ওয়াশিংটনও মনে হচ্ছে এবার পাকিস্তানকে শুধুমাত্র ‘প্রান্তিক বিরক্তি’ হিসেবে নয়, বরং এক কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে।
এই পদক্ষেপগুলো যেন নতুন গতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। ইসলামাবাদ ও রিয়াদের বিশ্লেষকরা একে বলছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির পুনর্জাগরণ-দেশের কৌশলগত অপরিহার্যতার বিলম্বিত স্বীকৃতি। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের গাজা শান্তি সম্মেলনে উপস্থিতি সেই ধারণাকেই আরও জোরদার করেছে-মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে ফেরার পথে এক দেশ।
কিন্তু এটি কোনো অলৌকিক পরিবর্তন নয়। বরং এটি প্রয়োজন, চাপ এবং অস্থির আঞ্চলিক সমীকরণের ফসল। ঝকঝকে কূটনৈতিক ছবির আড়ালে রয়েছে আরও কঠিন বাস্তবতা।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রত্যাহার: পাকিস্তানের নতুন কূটনৈতিক তৎপরতার প্রথম চালিকা শক্তি হলো আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার। হঠাৎ সেই প্রস্থান একটি শূন্যতা তৈরি করেছে, যা ওয়াশিংটন এখনো পূরণ করতে পারেনি। শত্রুভাবাপন্ন ইরান ও জটিল তালেবান শাসনের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের এখন আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য নতুন অংশীদার দরকার। পাকিস্তান-তার ভৌগোলিক অবস্থান, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং আফগান রাজনীতিতে দীর্ঘ সংশ্লিষ্টতার কারণে-হঠাৎ করেই আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক দাবি, যাতে তিনি তালেবানকে বাগরাম বিমানঘাঁটি হস্তান্তরের আহ্বান জানান, যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক প্রভাব পুনরুদ্ধারের মরিয়া প্রচেষ্টারই প্রতিফলন। সেই কৌশল ব্যর্থ হলে, পাকিস্তানই হয়ে উঠবে ওয়াশিংটনের একমাত্র বিকল্প- যে দেশটির রয়েছে একই সঙ্গে লজিস্টিক সক্ষমতা ও রাজনৈতিক যোগাযোগ।
অস্থির যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক: দ্বিতীয় চালিকা শক্তি হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অস্বস্তিকর সম্পর্ক। গত এক দশকে ওয়াশিংটন তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে নয়াদিল্লিকে টেনে এনেছে, যা পাকিস্তানের কাছে হুমকিস্বরূপ মনে হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই সম্পর্কেও ফাটল দেখা দিয়েছে। ভিসা ও শুল্কসংক্রান্ত বিরোধ বেড়েছে, আর ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ওয়াশিংটনের ভ্রু কুঁচকেছে। আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বেইজিং সফরও পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে- ভারত তার বাজি কেবল পশ্চিমে রাখছে না। তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প, যা পূর্ব এশিয়ার স্বল্পমূল্যের রপ্তানিমুখী কৌশলের অনুকরণ, যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন শিল্পের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাই ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টিতে পাকিস্তান আবারও ভারসাম্য রক্ষার এক কার্যকর পাল্টা ওজন হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
খনিজ কূটনীতি ও বেলুচিস্তানের ক্ষোভ: তৃতীয় এবং সবচেয়ে জটিল বিষয় হলো ‘খনিজ কূটনীতি।’ ইসলামাবাদের ওয়াশিংটনমুখী তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু হলো বিরল খনিজ সম্পদের বিনিময়ে বিনিয়োগ আকর্ষণ। এসব খনিজের বড় অংশই বেলুচিস্তান প্রদেশে অবস্থিত। কাগজে-কলমে এটি দুই পক্ষের জন্যই লাভজনক মনে হয়-পাকিস্তান বিনিয়োগ পায়, আর যুক্তরাষ্ট্র পায় গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল। কিন্তু বাস্তবতা আরও অন্ধকার।
দশকের পর দশক ধরে শোষণের পরও বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র প্রদেশ। বহু অবকাঠামো প্রকল্প অচল পড়ে আছে, বিমানবন্দরগুলো ফাঁকা, বেকারত্বের হার উর্ধ্বমুখী। মার্চ ২০২৫-এ পাস হওয়া বেলুচিস্তান মাইনস অ্যান্ড মিনারেলস অ্যাক্ট স্থানীয় ক্ষোভকে আরও তীব্র করেছে। এই আইনে ইসলামাবাদকে প্রাদেশিক খনির নীতি ও লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এর ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে বিরোধীরা অভিযোগ করছে। ডানপন্থী ধর্মীয় দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (জেইউআই-এফ) পর্যন্ত এই আইনের বিরোধিতা করেছে- যা খুবই বিরল ঘটনা। তাদের মতে, এটি বেলুচ জনগণের সম্পদের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের দখলদারিত্বের আরেকটি উদাহরণ।
এই প্রতিক্রিয়া একটি ভয়াবহ প্রবণতা নির্দেশ করছে। স্থানীয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্পদ আহরণ শুধু ক্ষোভ ও বিদ্রোহকে উসকে দেয়। বিদেশি বিনিয়োগের নামে ইসলামাবাদ যদি আবারও বেলুচিস্তানকে প্রান্তিক করে রাখে, তবে যে ‘উন্নয়ন’ ইসলামাবাদে মুক্তির মতো দেখায়, সেটিই কোয়েটায় নিপীড়নের প্রতীক হয়ে উঠবে।
সব মিলিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির এই পরিবর্তনকে ‘নবজাগরণ’ বলা অতিরঞ্জন। বরং এটি এক প্রকার কৌশলগত চাপ, প্রয়োজন ও সুযোগের সমন্বয়। আফগান শূন্যতা, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের পুনর্গঠন এবং খনিজ কূটনীতি পাকিস্তানকে সাময়িকভাবে আলোচনার কেন্দ্রে এনেছে, কিন্তু মৌলিক দুর্বলতাগুলো এখনো রয়ে গেছে। ওয়াশিংটন আবারও তার স্বার্থ বদলালে পাকিস্তানকে ত্যাগ করতে দেরি করবে না। ভারতের কৌশলগত ওজনও কমছে না। আর বেলুচিস্তানের ক্ষোভ গভীরতর হবে যদি সম্পদ বণ্টনের ন্যায্যতা না আসে।
রিয়াদে করতালি, গাজা সম্মেলনে উপস্থিতি আর ওয়াশিংটনে করমর্দন-এগুলোকে পুনর্জাগরণের প্রতীক ভাবা ভুল হবে। পাকিস্তান আসলে চাপের মধ্যে কৌশলীভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছে, দুর্বলতাকে সুযোগে রূপ দিতে চাচ্ছে। কিন্তু আসল পরীক্ষা ঘরোয়া পর্যায়ে-যদি ইসলামাবাদ শাসনব্যর্থতা, আঞ্চলিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক অবিশ্বাস কাটাতে না পারে, তাহলে পররাষ্ট্রনীতির সব সাফল্যই ভঙ্গুর থেকে যাবে।
শেষ পর্যন্ত, কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তি বা খনিজ বাণিজ্যই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সামাজিক চুক্তির বিকল্প হতে পারে না। প্রকৃত নবজাগরণটি পাকিস্তান এখনো অর্জনের অপেক্ষায়।
(লেখক: হের্টফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জাতিসংঘ দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যালয়ের প্রিভেনশন ওয়েব প্ল্যাটফর্মের কন্ট্রিবিউটর। তার এ লেখাটি অনরাইন আল জাজিরা থেকে অনুবাদ)

