জসিম সিদ্দিকী, কক্সবাজার: উচ্চ আয়ের আশায় মধ্যপ্রাচ্যের পথে যাত্রা করেছিলেন কক্সবাজারের মহেশখালীর তরুণ আরিফুল ইসলাম (২৬)। কিন্তু সেই স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। আরব আমিরাতে মানব পাচারকারীদের নির্মম নির্যাতনে মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুর ১৬ দিন পর, ২৪ জুন ২০২৫ দেশে ফিরে আসে তার নিথর দেহ। আরিফুলের বাড়ি কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মহেশখালী ইউনিয়নের দেবাঙ্গা পাড়ায়। তার পিতা মো. জাকারিয়া এবং মাতা সবে মেরাজ।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুন মাসে একটি সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে আরিফুলকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার করা হয়। দেশীয় ও প্রবাসী দালালদের সহযোগিতায় তাকে প্রথমে দুবাই ও পরে আবুধাবিতে নেওয়া হয়। এক পর্যায়ে তাকে হস্তান্তর করা হয় একটি আন্তর্জাতিক পাচার সিন্ডিকেটের হাতে।
সেই সিন্ডিকেটের হেফাজতে আরিফুল শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন এবং গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় দুবাইয়ের আল কাসেমি হাসপাতালে। ২৭ মে থেকে ৮ জুন পর্যন্ত চলে তার জীবন-মৃত্যুর লড়াই। এ সময় পাচারকারীরা তার পরিবারকে বিভ্রান্ত করতে তিন দফায় ভিন্ন ভিন্ন মৃত্যুর তারিখ জানায়—প্রথমে ৪ জুন, পরে ৭ জুন এবং চূড়ান্তভাবে ৯ জুন ২০২৫।
তবে স্থানীয় কিছু সচেতন প্রবাসী আরিফুলের অবস্থান শনাক্ত করে ভিডিও ও ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করলে সত্যতা সামনে আসে। তখনো জীবিত থাকা অবস্থায় সামান্য চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু পাচারকারীরা পরে তার খোঁজ রাখে না। অবশেষে ৯ জুন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং পাচারকারীদের যৌথ চক্রান্তে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
দীর্ঘ প্রবাসী সহায়তা ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করে পরিবার। ২৪ জুন দুপুর ১২টায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায় তার মরদেহ। সেদিন রাত ১০টার দিকে মরদেহ পৌঁছে নিজ গ্রামের বাড়িতে। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া।
আরিফুলের পরিবার এই মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছে। তারা দ্রুত পাচারকারীদের গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় আনার দাবি জানায়।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত স্থানীয়ভাবে চিহ্নিত পাচারকারীরা হলেন, আব্দুল গফুর (পিতা: ছোট মিয়া), তামিম (গফুরের পুত্র), আব্দুল মোনাফ (পিতা: মোহাম্মদ আলী), আবদুর রহিম (পিতা: মোহাম্মদ আলী), মুজাহেদ (পিতা: মোহাম্মদ আলী), ওসমান (পিতা: বাদশা মাঝি) — যিনি মূল ঘাতক বলে দাবি করা হচ্ছে।
ঘটনার বিষয়ে আরিফুলের মেঝ ভাই মোহাম্মদ নছরুল্লাহ জানান, "এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়—একটি পরিকল্পিত ও পেশাদার পাচারচক্রের নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড। আমরা ন্যায়বিচার চাই।"
এই মর্মান্তিক ঘটনা কক্সবাজারজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সচেতন মহল বলছেন, বিদেশে কর্মসংস্থানের নামে এমন প্রতারণা ও নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। মানব পাচার রোধে দালাল চক্রকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার জোর দাবি উঠেছে সর্বমহলে।