ঢাকা
২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সকাল ১০:২৬
logo
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৫

ডেঙ্গুর ধরন বদলাচ্ছে, বাড়ছে জটিলতা ও মৃত্যু

দেশে বাড়ছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। একদিকে থেমে থেমে বৃষ্টি, অন্যদিকে মশকনিধন কার্যক্রমের ঘাটতি। এই দুইয়ের সম্মিলিত প্রভাবে বাড়ছে ডেঙ্গুর বিস্তার। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, ডেঙ্গুর নতুন ধরন (ডেন-৩) সংক্রমণকে আরো জটিল করে তুলছে।

ঢাকা ও বরিশাল বিভাগে রেকর্ড সংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়েছে, মৃত্যুহারও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শুধু এ বছরেই দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৪৪ হাজার মানুষ। মারা গেছেন ১৮৭ জন।

চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ শুধু সংখ্যার দিক থেকেই নয়, জটিলতার দিক থেকেও উদ্বেগজনক। সেকেন্ডারি ইনফেকশন, দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, এবং সঠিক সময় চিকিৎসা না পাওয়া মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। নতুন ধরন নিয়ে আসছে ভিন্ন উপসর্গ, যা রোগ শনাক্তে দেরি ঘটাচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে জটিলতা ও বাড়ছে ঝুঁকি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করছে। ২০২৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর ধরন বা ভেরিয়েন্ট‑২ ছিল সর্বাধিক সংক্রমণ সৃষ্টিকারী রূপ। তবে চলতি বছরে, বিশেষত গত এক মাসে রাজধানীজুড়ে ডেঙ্গুর ধরন‑৩ আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। এই নতুন ধরনের সংক্রমণ ঢাকার হাসপাতালগুলোতে মৃত্যুহারকে বাড়িয়ে তুলেছে, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকারি সংস্থা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানায়, ঢাকায় ডেঙ্গুর ধরন-৩ আক্রান্ত রোগীর হার বাড়ছে, যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঢাকায় তুলনামূলক বেশি। এর ফলে রোগীর জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি আগের বছরের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক মুশতাক হোসেন বলেন, নতুন ধরন‑৩–এ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটা একটা বিপৎসংকেত। আগের ধরন‑২–এ আক্রান্ত ব্যক্তিরা এখন দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

তিনি আরো জানান, দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে, শরীরের অ্যান্টিবডি ভিন্ন সেরোটাইপে বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, ফলে রোগের তীব্রতা ও জটিলতা বাড়ে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক রেজাউল হক সামি বলেন, “ধরন‑২ নিয়ে যারা আগে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই অ্যান্টিবডি নতুন ধরন‑৩ থেকে রক্ষা দিতে পারছে না। বরং, দ্বিতীয়বার সংক্রমণ তাদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠছে।”

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২১৯ জন। তবে এই সময়ের মধ্যে কারো মৃত্যু হয়নি।

গতকাল ২৬ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের হাসপাতালগুলোতে ৭৯, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭৪ জন, বরিশাল বিভাগে ৪৩ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ২৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৪৩ হাজার ৮৪১ জন। এদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ১৮৭ জন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতেই আক্রান্তের হার ২৬ শতাংশ।

ঢামেক হাসপাাতলের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সরোয়ার হোসেন জানান, ধরন‑৩ নতুন ধরনের উপসর্গ নিয়ে আসছে, যা চিকিৎসকদের জন্য রোগ নির্ণয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

তিনি বলেন, “অনেক রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন, যা পূর্বের ধরনগুলোর ক্ষেত্রে এতটা প্রচলিত ছিল না। ফলে রোগের ধরণ চেনা মুশকিল হয়ে পড়ছে। আবার অনেক সময় দ্বিতীয় দফায় জ্বর হয়। যেটা সাধারণ রোগীদের জন্য বিভ্রান্তিকর।”

ঢাকার যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা কবির হোসেন প্রথমে সাধারণ জ্বর ভেবে প্যারাসিটামল খান। পরে শরীরে তীব্র ব্যথা এবং বাথরুমে ঘন ঘন যাওয়ার প্রবণতা দেখে তিনি ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষায় দেখা যায়, তিনি ধরন‑৩ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।

বরগুনা ও বরিশালের চিত্র: ঢাকার বাইরে বরগুনা ও বরিশাল বিভাগেও ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ। বরগুনাতে এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৬৩১ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ১১ জন। পুরো বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১২ হাজার ১৭০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন জানান, থেমে থেমে বৃষ্টি এবং মশকনিধন কার্যক্রমে ঘাটতি থাকায় সংক্রমণ বাড়ছে।

তিনি বলেন, “অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হতে পারে। পরিস্থিতি যদি না পাল্টায়, তাহলে সংক্রমণ আরও বেড়ে যেতে পারে।”

তিনি বলেন, “শুধু সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। দরকার জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং কমিউনিটি ভিত্তিক মশা নিয়ন্ত্রণ।”

ইনসেক্ট গ্রোথ রেগুলেটর ট্যাবলেট বিতরণ এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন বলে তিনি জানান।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাজমুল আহসান বলেন, “যারা বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খেতে হবে। যেমন স্যালাইন, ডাবের পানি, ভাতের মাড়, ঘরে তৈরি স্যুপ ও ফলের রস।”

জ্বর সেরে যাওয়ার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় জানিয়ে তিনি বলেন, “এই সময় রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে পারে, তাই নিবিড় পর্যবেক্ষণ জরুরি।”

পরামর্শ: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশন থেকে জনসাধারণকে সতর্ক করা হয়েছে। বিশেষভাবে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাড়ির চারপাশে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করা। সপ্তাহে অন্তত একদিন ডেঙ্গু ডে পালন করে পাত্র ও ফুলদানিতে পানি জমতে না দেওয়া। দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করা। শরীরের যতটা সম্ভব অংশ ঢেকে রাখা। জ্বর হলে অবহেলা না করে দ্রুত পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মো. সানাউল হক বলেন, “ডেঙ্গুর ধরন‑৩ এখন শুধু ঢাকা নয়, বরগুনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংক্রমণের নতুন ঢেউ সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয়বার সংক্রমিত রোগীদের ঝুঁকি বেশি হওয়ায় চিকিৎসা ও সচেতনতায় অবহেলা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।”

logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ এডভোকেট মো: গোলাম সরোয়ার
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram