বিশ্ববাজার নিম্নমুখী থাকায় গত বছর রেকর্ড পৌনে ৭৩ লাখ টন গম আমদানি করেন দেশের আমদানিকারকরা। এবছরও সে ধারা অব্যাহত। কিন্তু উল্টো চিত্র বাজারে। গত এক সপ্তাহে বাজারে গম থেকে প্রস্তুত করা আটার দাম বেড়েছে হু হু করে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি আটার দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা। কোম্পানিগুলো তাদের প্যাকেটজাত আটার কেজি বিক্রি করছে কমবেশি ৬০ টাকা, যা আগে ৫০-৫২ টাকা ছিল। খোলা আটার দামও ৫ টাকা বেড়ে মানভেদে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা হয়েছে।
বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় দুই কেজি ওজনের আটার প্যাকেট। আগে কোম্পানিগুলোর প্যাকেটের গায়ের দাম ছিল ১১০ টাকা, যা এখন ১৩০ টাকা হয়েছে।
এদিকে খোলা ও প্যাকেটজাত উভয় ধরনের আটার দাম বাড়ায় ভোক্তাদের, বিশেষ করে সীমিত আয়ের ক্রেতাদের ওপর চাপ বাড়ছে। কারণ, চালের পরই সবচেয়ে বেশি ভোগ হয় আটা।
দেশি-বিদেশি তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, কোম্পানিগুলোর অতি মুনাফার প্রবণতা ছাড়া দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। এ সময়ে বিশ্ববাজারে গমের দাম বাড়েনি, বরং কমেছে। গম আমদানিও বেড়েছে অনেকাংশে।
বেশ কিছু কারণে কোম্পানিগুলোর ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়ছে। বাজেটের এআইটি আরোপ করা হয়েছে, টার্নওভার ট্যাক্স বেড়েছে। সেগুলো সমন্বয় করে আগের দামে পণ্য বিক্রি করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।- সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা
ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য বলছে, যেখানে গত বছর এ সময় (সেপ্টেম্বর) বিশ্ববাজারে প্রতি টন গমের দাম ছিল ২৬৮ থেকে ২৭২ ডলার, তা এখন কমে ২১৪ থেকে ২১৯ ডলারে এসেছে। শুধু গত বছরই নয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই ক্রমাগত কমছে গমের দাম। ২০২২ সালে গমের দাম ৫০০ ডলারে উঠেছিল।
তবে দেশের বাজারের তথ্য বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় আটার দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করা হলেও এরপর বিশ্ববাজারে নিম্নমুখী হওয়ার সুফল পায়নি ভোক্তারা। বরং, এখন হুট করে দাম বাড়ানো হচ্ছে।
মাঝে কয়েক বছর দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও এলসি খোলায় সংকট ছিল। এখন সেসব সমস্যাও নেই। তারপরেও বাড়ছে দাম।
দেশের শীর্ষস্থানীয় খাদ্যশস্য আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে গত বছর গমের দাম বেশ কম ছিল। মাঝে একটু বাড়লেও তারপর আবার কমেছে। যে কারণে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের আমদানিতে আগ্রহ বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সবশেষ কয়েক বছর ৬০ থেকে ৮০ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। যার বেশিরভাগ কানাডা, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। এছাড়া দেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বাজার বড় হওয়ায় একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।’
এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘বেশ কিছু কারণে কোম্পানিগুলোর ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়ছে। বাজেটের এআইটি আরোপ করা হয়েছে, টার্নওভার ট্যাক্স বেড়েছে। সেগুলো সমন্বয় করে আগের দামে পণ্য বিক্রি করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’
দীর্ঘদিন গমের দাম কম ছিল, তখন তারা দাম সমন্বয় করেনি। কিন্তু যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়েছিল, তারা সঙ্গে সঙ্গে আটা-ময়দার দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়েছিল।- ক্যাব সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘দীর্ঘদিন গমের দাম কম ছিল, তখন তারা দাম সমন্বয় করেনি। কিন্তু যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়েছিল, তারা সঙ্গে সঙ্গে আটা-ময়দার দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘তখন আমরা দেখেছি পরোটা, বিস্কুট, ফাস্টফুড- সবকিছুর দাম বেড়েছে, যা ভোক্তাদের প্রচণ্ড চাপে ফেলেছিল। আবার তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। আসলে তাদের নীতি ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতো। তারা আসলে মনে করে, এ সরকার কিছু করবে না। তাই গুটিকয়েক কোম্পানি যা ইচ্ছা তাই করে। কাউকে তোয়াক্কা করে না।’
দেশে গমের চাহিদার ১৪-১৫ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। আর চাহিদার বাকি ৮৫ শতাংশই আমদানি হয়। ২০২৪ সালে প্রায় ৭২ লাখ ৭৫ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে। ২০২৩ সালে আমদানি হয়েছিল ৫৪ লাখ ১৭ হাজার টন। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে গম আমদানি বেড়েছিল প্রায় ৩৪ শতাংশ। আমদানি বৃদ্ধির এই হার গত আট বছরে সর্বোচ্চ ছিল। এবছরও গম আমদানি বেড়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়া গেলেও আমদানির পরিমাণ প্রায় ৯ মাসে ৪৫ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে বলে তথ্য দিয়েছেন আমদানি সংশ্লিষ্টরা।
মানুষ এখন আগের তুলনায় গমের খাদ্যপণ্য বেশি খাচ্ছে। গমের তৈরি খাদ্যপণ্যের রপ্তানিও বাড়ছে। চাহিদার কারণে গত বছর রেকর্ড পরিমাণ গম আমদানি হয়েছে। গত বছর উৎপাদন ও আমদানি মিলে গমের সরবরাহ ছিল ৮৪ লাখ ৪৭ হাজার টন, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।