মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেন না হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক একেএম মাকসুদুল ইসলাম। গত রবিবার তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তেই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। তার সঙ্গেই ফেঁসে যাচ্ছেন সাবেক মন্ত্রী-সচিবসহ নেপথ্যের রাঘববোয়ালরাও।
মেগা প্রকল্প শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। ৭ হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালক একেএম মাকসুদুল ইসলামের হাত থাকলেও এতে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়েন রাঘববোয়ালরা। প্রতিমন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানসহ একাধিক সদস্য-সচিবের সাথে দহরম-মহরম থাকায় তার অনিময় ও দূর্নীতির ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু তার নিয়োগের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে বারবার। আর্থিক সুবিধা দিয়ে এবং নানাভাবে সবাইকে ম্যানেজ করে ওই পদে বহাল ছিলেন মাকসুদুল ইসলাম।
গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে দুর্নীতি তদন্তে গঠন করে কমিটি। গত রবিবার জারি করা এক অফিস আদেশে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রকল্প পরিচালকের নিয়োগ বাতিল করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। প্রাথমিক তদন্তেই দুর্নীতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে সাবেক মন্ত্রী, সচিবসহ নেপথ্যের কুশীলবরা ফেঁসে যাচ্ছেন বলে সূত্রের তথ্য।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত ওই আদেশে বলা হয়, গত ১২ ফেব্রুয়ারি মাকসুদুল ইসলামের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ১ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। তবে গতকাল সোমবার থেকে তার চুক্তি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার দেড় মাস আগে তার নিয়োগ বাতিল করা হলো।
বেবিচক সূত্র জানায়, মাকসুদুল ইসলাম ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর বেবিচক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদ থেকে অবসরে যান। এর আগেই মাকসুদুল ইসলাম ও তার নির্ভরশীলদের সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দেয় দুদক। দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের পাঠানো নোটিশে স্বনামে-বেনামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, দায়দেনা, আয়ের উৎস ও তা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণী জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। অবসরে যাওয়ার পরপরই তাকে থার্ড টার্মিনালের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য ডিও লেটার দেন তৎকালীন বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। নিয়োগও পেয়ে যান তিনি। ফলে তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানে ভাটা পড়ে। চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার বাড়ানো হয় মেয়াদ।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পের কেনাকাটা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। শুরুর দিকে দক্ষিণ কোরিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য নিম্নমানের সরঞ্জাম ও পণ্য কেনা হয়েছিল। বেবিচকের নজরে আসার পর এসব পণ্য যাচাই করে বেশির ভাগই নিম্নমানের প্রমাণ হওয়ায় সেগুলো সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রকল্প পরিচালককে ম্যানেজ করে ঠিকাদার দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বেশ কিছু মানহীন বৈদ্যুতিক পণ্য আনেন। সেগুলো যাচাই-বাছাই করার পর সব নিম্নমানের ধরা পড়ায় ফেরত পাঠানো হয়। থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের তিনটি বড় কাজ নির্ধারিত ঠিকাদারের পরিবর্তে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ আছে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে। জাপানি ঠিকাদারকে পাশ কাটিয়ে প্রকল্প পরিচালক তার পছন্দের কয়েকজন ঠিকাদার দিয়ে বেশ কিছু অতিরিক্ত কাজ করান থার্ড টার্মিনালে। ভিভিআইপি সড়ক থেকে থার্ড টার্মিনালে প্রবেশের জন্য একটি সাধারণ ব্রিজ নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৪ লাখ টাকা। অথচ পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে ১২ কোটির বেশি টাকা খরচ করেন প্রকল্প পরিচালক। তদন্ত কমিটি থার্ড টার্মিনাল নির্মাণে সীমাহীন অনিয়মের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের জন্য পাথর ও মার্বেল কেনা হয় সিলেট থেকে। কিন্তু ইতালি থেকে ক্রয় দেখিয়ে সে পাথরের ইন্সপেকশন করতে প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা ইতালি ভ্রমণ করেন। এ ছাড়া ১৮শ স্কয়ার ফুট টাইলসের মান দেখতেও বিদেশ ভ্রমণের অভিযোগ আছে প্রকল্প পরিচালকসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে। প্রকল্পের সাড়ে ৬ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পর রহস্যজনকভাবে পরিবর্তন করা হয় নকশা। প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করে প্রায় ৭১১ কোটি থেকে ৯শ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের মূল নকশায় টার্মিনাল ভবনের পাইলিং করার কথা ছিল বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির স্টিল স্ক্রুয়েড পাইল (এসএসপি)। কিন্তু নকশা পরিবর্তন করে মান্ধাতা আমলের বোরড পাইলিং করা হয়। নকশায় পরিবর্তন আনায় প্রকল্প ব্যয় ৯শ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় দেখানো হয়। এই টাকা দিয়ে একটি অত্যাধুনিক ভিভিআইপি টার্মিনাল ও প্রকল্পকে ইউ আকৃতির রূপ দেওয়ার জন্য দুটি পিয়ার যুক্ত করার কথা ছিল। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, ফান্ডে কোনো টাকা নেই। প্রকল্পকে ইউ আকৃতি করার জন্য অতিরিক্ত ৩ হাজার কোটি টাকা লাগবে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে ৯শ কোটি টাকা গেল কোথায়? প্রকল্পের কাজ শেষ না করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটির সফট উদ্বোধন করায় অর্ধশত কোটি টাকা অযৌক্তিক খরচ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য।
জানা গেছে, প্রকল্পটি জাপানি কোম্পানির তত্ত্বাবধানে হলেও পুরো প্রকল্পের কেনাকাটা ও সরঞ্জাম সংযোজনের অলিখিত নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী ও বেবিচকসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। তার ডান হাত হিসেবে সব কিছু সামলাতেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মাকসুদুল ইসলাম। সম্প্রতি প্রয়াত বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফ গণমাধ্যমে বলেছিলেন, থার্ড টার্মিনালের অস্বাভাবিক ব্যয় খতিয়ে দেখা হবে। প্রকল্পের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দ্রুত থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পসহ বেবিচকে সংস্কার করা হবে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।
এদিকে তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে মাকসুদুল ইসলাম বলেন, আমার যতটুকু মেধা ছিল তা দিয়ে দেশের জন্য কাজ করেছি। একটু সুন্দর ভালো জিনিস হয়েছে। ফাইন্যান্সিয়ালিও ভালো ছিল। আমি ব্যক্তিগত কোনো অ্যাডভানটেজ নিইনি।
বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবির ভূঁইয়া বলেন, থার্ড টার্মিনালের অনিয়ম-দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বিষয়টি দেখছে। কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।