কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, ঠিক সেই সময়ে ভারতের নৌবাহিনীর জন্য ফ্রান্সের কাছ থেকে ৬৩০ বিলিয়ন রুপি মূল্যের ২৬টি রাফাল এম যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি সই হয়েছে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য সংগ্রহে যোগ হচ্ছে ২২টি এক আসনের এবং চারটি দুই আসনের রাফাল এম ফাইটার জেট। এর আগে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান থাকলেও নৌবাহিনীর বহরে প্রধানত রুশ নির্মিত মিগ-২৯ জেট ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
রাফাল এম যুদ্ধবিমানটি নৌবাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। এটি রণতরী থেকে সরাসরি উড্ডয়ন ও অবতরণে সক্ষম। এতে ব্যবহৃত হয়েছে উন্নত রাডার, ইলেকট্রনিক যুদ্ধব্যবস্থা এবং শক্তিশালী অবকাঠামো। রাফাল এম বিমানটি এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু গ্রাউন্ড এবং অ্যান্টিশিপ মিসাইল বহনে সক্ষম। এছাড়া এতে এমন একটি সুরক্ষা প্রযুক্তি রয়েছে, যা শত্রু রাডার ও মিসাইল থেকে বিমানটিকে রক্ষা করতে পারে।
পেহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার কিছুদিন আগেই ফ্রান্সের সঙ্গে ভারতের এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছিল। হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উত্তেজনা বেড়েছে এবং যুদ্ধের শঙ্কাও বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর, তবে সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত অনেকটাই এগিয়ে।
বিশ্লেষকদের মতে, রাফাল মেরিন ভারতের নৌশক্তিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র সাংবাদিক কমার আঘা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এই চুক্তি ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও আধুনিকতম প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও মজবুত করে তুলবে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর কাছে ইতোমধ্যে রাফাল যুদ্ধবিমান রয়েছে। এখন নৌবাহিনীর কাছেও তা থাকবে।’
যুদ্ধবিমান ভারতে আসতে এবং ব্যবহার শুরু হতে আরেও কয়েক বছর লাগলেও, এই চুক্তি স্বাক্ষর করা একাধিক কারণে বিশেষ ইঙ্গিতবহ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে রাফাল চুক্তির পিছনে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী ভাবনা রয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত ফাইটার এয়ারক্র্যাফ্ট পাইলট এবং প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্রফুল্ল বক্সী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘এই চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছে একটা বার্তা তো যাবেই পাশাপাশি, চীনের কাছেও একটা বার্তা পৌঁছাবে।’
রাফাল-এম চুক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ভারত গত কয়েক দশক ধরে নিজেদের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকে চারদিক থেকে মজবুত করার চেষ্টা করে এসেছে। বিশ্বের সামরিক শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে একাধিক দেশের সঙ্গে এই খাতে বিভিন্ন চুক্তিও হয়েছে।
বক্সী ব্যাখ্যা করেছেন, ‘প্রতিরক্ষার কথা ভেবেই কিন্তু '৬০ দশকে এয়ারক্র্যাফ্ট ক্যারিয়ার আনা হয়। তারপর হ্যারিয়ার জাম্পজেট, মিরাজ, এমআইজি ২৯কে থেকে শুরু করে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে একদিক নয় সমস্তদিক থেকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিমানবাহিনীর কাছে ইতোমধ্যে রাফাল যুদ্ধবিমান ছিল এখন তা নৌবাহিনীর কাছেও থাকবে।’
প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও আধুনিকীকরণ প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ মনোজ যোশীর কথায়, ‘বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর কাছে একই ধরনের যুদ্ধবিমান থাকার ফলে তাদের মধ্যে সমন্বয় বাড়বে। এই যুদ্ধবিমানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রেও সুবিধা হবে।’
মি. বক্সী আবার বলেছেন, ‘ফ্রান্সের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পুরানো। সে দেশের সঙ্গে এর আগেও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চুক্তি হয়েছে। কাজেই সেই দিক থেকে দুই দেশের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখেও এই চুক্তির গুরুত্ব আছে।’
চীন ও পাকিস্তান
সাম্প্রতিক এই চুক্তি চীন এবং পাকিস্তানকে 'মোকাবিলা' করতে সাহায্য করবে কি না জানতে চাওয়া হলে যোশী বলেছেন, ‘আমার মনে হয় পাকিস্তানকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এই যুদ্ধবিমান বেশি কার্যকরী হবে।’
সাউথ এশিয়ান পলিটিক্স এন্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিস-এর গবেষক এবং মানব রচনা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক উপমন্যু বসুর মতে এই চুক্তির পিছনে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেছেন, ‘ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের উপস্থিতির বিষয় ভারত অনেক আগে থেকেই সতর্ক ছিল। সেকথা মাথায় রেখেই কিন্তু নৌবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আগে থেকেই মজবুত করার বিষয়ে মনোনিবেশ করেছে ভারত। এখানে পাকিস্তান কিন্তু সরাসরি ঝুঁকি নয়। বরং বড় ঝুঁকি হলো চীন ‘
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, চীনের কথা মাথায় রেখেই ভারত নিজেদের আরও মজবুত করছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা