দ্রুতগতির নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেটের জন্য স্টারলিংক নামটি বিশ্বজুড়েই ছিল আস্থার প্রতীক। তবে সেই নির্ভরতার দেওয়ালে ধাক্কা দিয়েছে এক অস্বাভাবিক প্রযুক্তিগত বিভ্রাট। ২৪ জুলাই ২০২৫ বিশ্বজুড়ে বড় ধরনের বিভ্রাটের শিকার হয় ইলন মাস্কের এই প্রতিষ্ঠানটি।
প্রায় ৬০ লাখ ব্যবহারকারী আড়াই ঘণ্টা ধরে আংশিক বা সম্পূর্ণ ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হন। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বিকাল ৩টা (বাংলাদেশ সময় রাত ১টা) থেকে শুরু হওয়া এ সমস্যা দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। স্থিতিশীল সেবায় আস্থা থাকা ব্যবহারকারীদের মধ্যে সিগন্যাল হারানোর ফলে ইন্টারনেট নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট বন্ধ থাকার খবর পাওয়া যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়, এটি স্টারলিংকের ইতিহাসের অন্যতম বড় প্রযুক্তিগত বিপর্যয়।
কী হয়েছিল?
স্পেসএক্স পরিচালিত স্টারলিংক সেবা ১৪০টিরও বেশি দেশে ৬০ লাখের বেশি ব্যবহারকারীকে ইন্টারনেট দিচ্ছে। এ ব্যবস্থার পেছনে রয়েছে একটি জটিল ও উচ্চনির্ভরযোগ্য স্যাটেলাইট-নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচার। কিন্তু সেই অবকাঠামোই মাত্র একটি সফটওয়্যার ত্রুটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে।
স্টারলিংকের নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইকেল নিকোলস স্পষ্ট জানান, ‘আমাদের কোর নেটওয়ার্কচালিত একাধিক অভ্যন্তরীণ সফটওয়্যার সার্ভিস আচমকাই ব্যর্থ হয়ে পড়ে। এর ফলে রাউটিং ও সংযোগ ব্যবস্থায় চেইন রি-অ্যাকশন শুরু হয় এবং বহু ব্যবহারকারী ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।’
বিশ্লেষকদের ভাষায়, এটি ছিল ‘একটি একক পয়েন্ট অব ফেইলিউর’ যা সিস্টেমে রিডান্ডেন্সির ঘাটতির দিকে আঙুল তোলে।
ইলন মাস্ক কী বললেন?
ঘটনার কিছুক্ষণ পরই স্টারলিংকের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক এক্স (পূর্বতন টুইটার)-এ লেখেন, ‘এ বিভ্রাটের জন্য দুঃখিত। স্পেসএক্স সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করে তা সমাধানে কাজ করবে যাতে এটি আর না ঘটে।’
এই এক লাইনের ক্ষমা চাওয়ার ভেতরে একদিকে যেমন দুঃখ প্রকাশ রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভবিষ্যতের জন্য প্রতিশ্রুতি। তবে প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু ক্ষমা চাওয়া যথেষ্ট নয়, নেটওয়ার্ক স্থিতিশীলতার জন্য এখন প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন
প্রভাব কতটা গভীর?
বিভ্রাটটি শুধু ঘরোয়া বা অফিস ব্যবহারকারীদের সীমাবদ্ধ ছিল না। ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ ডাউনটাইমের কারণে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ ও গোয়েন্দা যোগাযোগ কার্যক্রমে বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রেও স্টারলিংকের ওপর নির্ভরতা থাকায়, এমন একটি প্রযুক্তিগত সমস্যা কৌশলগত নিরাপত্তা প্রশ্নে ফেলেছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু রিমোট হাসপাতাল ও জরুরি পরিষেবা বিভাগও বিভ্রাটকালীন তাদের বিকল্প ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হয়।
আপডেট নাকি ভেতরের ঘাটতি?
অনেকে ধারণা করছেন, মূল সমস্যা শুরু হয়েছিল একটি রুটিন সফটওয়্যার আপডেট থেকে। কোনো কনফিগারেশন ভুল বা সিস্টেমের একাধিক সার্ভিসের একযোগে ব্যর্থতা পুরো নেটওয়ার্ক অচল করে দেয়। যদিও এখনো চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি, তবে প্রাথমিক বিশ্লেষণ বলছে-স্টারলিংকের মূল অপারেশন প্ল্যাটফর্মে পর্যাপ্ত ফেইল সেইফ ব্যবস্থা নেই।
ভবিষ্যতের সংকেত
এ ঘটনা স্টারলিংকের জন্য শুধু প্রযুক্তিগত নয়, এক ধরনের আস্থার সংকটও তৈরি করেছে। যে প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের ‘ফিউচার অব কানেক্টিভিটি’ হিসাবে দাবি করে, তাদেরই কোর সিস্টেম এমন ভঙ্গুর হয়ে পড়লে প্রশ্ন ওঠে, আসলে কতটা প্রস্তুত তারা বৈশ্বিক স্কেলে ইন্টারনেট স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন সময় এসেছে স্টারলিংকের ভেতরের কাঠামোতে পরিবর্তন আনার-বিশেষ করে সফটওয়্যার রিডান্ডেন্সি, মাল্টি-জোন নেটওয়ার্ক কনফিগারেশন এবং ডিজাস্টার রিকভারি নীতিমালায়।
এই বিভ্রাট প্রযুক্তি জগতে একটি সতর্ক সংকেত-সবচেয়ে আধুনিক, মহাকাশভিত্তিক ইন্টারনেট সার্ভিসও একটি সফটওয়্যারের ভুলে মুহূর্তে থমকে যেতে পারে। ভবিষ্যতের জন্য এ ঘটনা শুধু স্টারলিংকের নয়, বরং পুরো স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ইন্ডাস্ট্রির জন্যই একটি চ্যালেঞ্জ।
বিশ্ব এখন ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। আর এ নির্ভরতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে, প্রযুক্তির আড়ালে থাকা কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোকেও এখন শক্ত হাতে ঠিক করতে হবে।