বরগুনায় বেড়েই চলেছে অনুমোদনহীন ও লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ও লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সম্পূর্ণ বেআইনি হলেও বছরের পর বছর ধরে অনেক প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র আবেদন জমা দিয়েই চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ রোগীরা, অন্যদিকে বেড়েছে ভুল চিকিৎসার ঝুঁকিও।
বরগুনায় প্রায় ১২ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবায় সরকারি হাসপাতালের পর ভরসার জায়গা অসংখ্য বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। জেলায় ১২২টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও লাইসেন্স আছে মাত্র ২৬টির।
‘স্ত্রী অসুস্থ হলে তাকে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়। সেখানে রিপোর্ট অনুযায়ী আমার স্ত্রীর পিত্তথলি ভালো আছে বলে রিপোর্ট দেওয়া হয়। অথচ ছয় মাস আগে তার পিত্তথলিতে সমস্যা দেখার কারণে ঢাকায় অপারেশন করে পিত্তথলি ফেলে দেওয়া হয়।’
শুধু লাইসেন্স নয়, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক পরিচালনার ক্ষেত্রে হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন/আয়কর প্রত্যয়নপত্র, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নম্বর, পরিবেশ ছাড়পত্র, নারকোটিক পারমিট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চুক্তিপত্রসহ বেশকিছু কাগজপত্র এবং অবকাঠামোগত বিষয় নিয়মানুযায়ী থাকতে হবে। এসবের পর থাকতে হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন। এর পাশাপাশি প্রয়োজন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (প্যাথলজিস্ট), একজন করে রিপোর্ট প্রদানকারী, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ পরিচ্ছন্নকর্মী। আর ক্লিনিকের ক্ষেত্রে এসবের বাইরেও সার্বক্ষণিক ডাক্তার, নার্সসহ বেশকিছু যন্ত্রপাতি থাকা বাধ্যতামূলক।
তবে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, লাইসেন্স নবায়ন কিংবা নতুন অনুমোদন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ঘুষ বাণিজ্য এবং ছাড়পত্রের অনির্ধারিত ধাপগুলোর কারণে অনেকেই নিরুপায় হয়ে অনুমোদন না নিয়েই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।
স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১২২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু ক্লিনিক রয়েছে ৩১টি। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন লাইসেন্সের জন্য ৭৫টি আবেদন জমা পড়েছে। এরমধ্যে নতুন করে ২৬টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স হালনাগাদ হয়েছে, যার মধ্যে ২০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ৬টি ক্লিনিক। পরিদর্শনের অপেক্ষায় রয়েছে আরও ৮টি এবং লাইসেন্স পেতে অপেক্ষমাণ আছে ১০টি প্রতিষ্ঠান। সব ধরনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরও ৭টি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র এখনো অসম্পূর্ণ। এছাড়া শুধু অনলাইনে আবেদন করে রাখা হয়েছে ২৪টি প্রতিষ্ঠানের।
‘নারকোটিকের লাইসেন্স পেতে ঘুষ দিতে হয়। টাকা না দিলে বিভিন্ন সমস্যা দেখায় তারা। আর টাকা দিলে কোনো সমস্যা থাকে না।’
সরেজমিনে বরগুনার ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুরে দেখা যায়, আমতলী উপজেলার ডক্টরস কেয়ার ক্লিনিক অ্যান্ড হাসপাতাল নির্মাণাধীন একটি ভবনে স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই চলছে। বছর খানেক আগে এই ক্লিনিকটি বরগুনা পৌর শহরে থাকলেও মালিকানা পাল্টে নেওয়া হয়েছে আমতলী উপজেলায়।
এদিকে পৌর শহরে ডক্টরস কেয়ারের স্থানে পেশেন্ট কেয়ার ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক নামে নতুন আরেকটি ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালনা হলেও সেটিরও একই অবস্থা। লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করলেও সব বিভাগের অনুমোদন না থাকায় স্বাস্থ্য বিভাগের ওয়েবসাইটে এটি অসম্পূর্ণ বলে দেখাচ্ছে।
এর থেকেও ভয়াবহ অবস্থা খোদ সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের ৩০০ মিটারের মধ্যে নিউ ল্যাব এইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। এখানে প্যাথলজিকাল ল্যাবে নেই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। তদারকি না থাকায় ২০২০ সালের পর আর লাইসেন্স হালনাগাদ করেনি তারা। এছাড়াও বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নে অবস্থিত আদম আম্বিয়া হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও কুয়েত প্রবাসী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুরে পাওয়া যায়নি আবাসিক চিকিৎসক। নামে একজন করে চিকিৎসক থাকলেও প্রতিবেদক দু’দিন সরেজমিনে গিয়েও তাদের পায়নি।
এছাড়া বরগুনা পৌর শহরের ফার্মেসি পট্টি এলাকায় কুয়েত প্রবাসী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠান চলছে টিনশেড ঘরে। একই এলাকায় পরিচালিত লেক ভিউ ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে ২৩-২৪ অর্থ বছরে। আর মা ডায়াগনস্টিক, মেডিনেট ক্লিনিক, অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক, লাইফ কেয়ার ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক, হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক, বরগুনা ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক, মিনতি ডায়াগনস্টিকের এখন পর্যন্ত নেই হালনাগাদ লাইসেন্স।
‘এ সমস্ত ক্লিনিকে বিশেষজ্ঞ পরীক্ষক ও চিকিৎসক কেউ নেই। এছাড়া যে কয়েকটি ক্লিনিকের বৈধতা আছে তাদেরও জনবল ও টেস্টের সরঞ্জামাদি ঠিক আছে কি না সেটি দেখা উচিত। শুধু কাগজপত্রে বৈধতা থাকলেই হবে না, সব বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খেয়াল করা উচিত।’
আল আমিন হিরা নামের এক রোগী বলেন, শারীরিক সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শে বরগুনার একটি ক্লিনিক কাম ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাই, সেখান থেকে টেস্টের রিপোর্টে বলা হয় কোনো ধরনের সমস্যা নেই। তারপরও আমার শারীরিক সমস্যা ও রিপোর্ট দেখে ডাক্তার আবার একটি পরীক্ষা করতে বলেন। পরদিনই অন্য একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একই টেস্ট করানোর পর আমার সমস্যা ধরা পড়ে। এভাবে ভুল রিপোর্ট দিলে আমরা সাধারণ রোগীরা যাব কোথায়? আমরা চাই স্বাস্থ্য বিভাগ যেন এ সমস্ত মানহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
পিত্তথলি ফেলে দেওয়ার পরও রিপোর্টে পিত্তথলি ভালো আছে, এরকম ভুল তথ্য দেওয়া রিপোর্টের বিষয়ে ভুক্তভোগী রোগীর স্বজন রেজাউল ইসলাম টিটু বলেন, বরগুনার অধিকাংশ ক্লিনিকেই ভুল রিপোর্ট দেওয়া হয়। সম্প্রতি আমার স্ত্রী অসুস্থ হলে তাকে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়। সেখানে রিপোর্ট অনুযায়ী আমার স্ত্রীর পিত্তথলি ভালো আছে বলে রিপোর্ট দেওয়া হয়। অথচ ছয় মাস আগে তার পিত্তথলিতে সমস্যা দেখার কারণে ঢাকায় অপারেশন করে পিত্তথলি ফেলে দেওয়া হয়। বিষয়টা নিয়ে আমি খুব অবাক হয়েছি। এরকম হলে রোগীদের ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
লাইসেন্স পেতে ভোগান্তির বিষয়ে সিটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক এবং সেফা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের পরিচালক মুফতি মো. মিজানুর রহমান কাসেমী বলেন, একটি লাইসেন্স পেতে আমাদেরকে ১০-১২টি লাইসেন্স করে আসতে হয়। এরমধ্যে নারকোটিকের লাইসেন্স পেতে ঘুষ দিতে হয়। টাকা না দিলে বিভিন্ন সমস্যা দেখায় তারা। আর টাকা দিলে কোনো সমস্যা থাকে না। তাই বাধ্য হয়েই এই দুর্নীতিতে আমাদেরও জড়াতে হচ্ছে।
বরগুনা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব ফজলে এলাহী সৈকত বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের লাইসেন্স পেতে আমাদের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ও ছাড়পত্র পেতে হয়। এই লাইসেন্সগুলো পেতে আমরা আবেদন করতে পারি একটি অর্থবছরের শুরুতে। আবার এসব লাইসেন্স পেতে কয়েক মাস সময় লাগে। এরপর আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের অনলাইনে লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করতে পারি। এরপর যাচাই-বাছাই শেষে সিভিল সার্জন মহোদয়ের প্রতিষ্ঠান ভিজিটের একটি বিষয় থাকে। তার দাপ্তরিক ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় দেরি হয়। তিনি রিপোর্ট দিলে ডিজি হেলথ আমাদের লাইসেন্স আবার যাচাই বাছাই করে লাইসেন্স প্রদান করেন। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই সময়টায় আমাদের লাইসেন্সবিহীন থাকা লাগে।
মানহীন ক্লিনিক চলছে স্বীকার করে তিনি বলেন, আমাদের মালিকদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। মালিকরা একটু সচেতন হলে আরেকটু আগেই লাইসেন্স পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা সেটা করি না। সিভিল সার্জন আমাদেরকে ওয়ার্নিং দেওয়ার পর থেকেই আমরা সমিতি থেকে চেষ্টা করছি আমাদের যে সকল প্রতিষ্ঠানের সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান করার।
নারকোটিক লাইসেন্স পেতে অর্থ দাবি করার বিষয়ে জানতে বরগুনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অফিসে গেলেও তারা বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। এছাড়া মুঠোফোনে বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ে ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বরগুনা জেলা শাখার সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, বরগুনায় ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। যেগুলোর বেশিরভাগেরই নিবন্ধন নেই। এছাড়া আরেকটি সমস্যা আছে, আর্থিক কারণ ও লাইসেন্স পেতে হয়রানির কারণেও তারা লাইসেন্স পাচ্ছে না বা পেতে দেরি হচ্ছে। এছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের মনিটরিংয়ের অভাবে অনেক ক্লিনিকেই সুচিকিৎসার পরিবর্তে অপচিকিৎসার শিকার হতে হয়। এছাড়া এ সমস্ত ক্লিনিকে বিশেষজ্ঞ পরীক্ষক ও চিকিৎসক কেউ নেই। এছাড়া যে কয়েকটি ক্লিনিকের বৈধতা আছে তাদেরও জনবল ও টেস্টের সরঞ্জামাদি ঠিক আছে কি না সেটি দেখা উচিত। শুধু কাগজপত্রে বৈধতা থাকলেই হবে না, সব বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খেয়াল করা উচিত।
এ বিষয়ে বরগুনা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ বলেন, সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোনো ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানো সম্পূর্ণ অবৈধ। এ বিষয়ে আমরা জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে কাজ করছি। লাইসেন্সবিহীন কাউকে পাওয়া গেলে সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।