বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ যেন উপজেলা অফিসের উদ্যান পরিচর্যাকারী বা মালি মো. তারিকুল ইসলাম হলুদের হাতে। শুধু নিয়ন্ত্রণ নয়, সরকারি গোপন নথি ব্যবস্থাপনা, দাপ্তরিক কম্পিউটার ব্যবহার, পাশাপাশি জন্মনিবন্ধন সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন মালি পদে নিয়োজিত ওই ব্যক্তি। এছাড়া অফিস সহকারীর নির্ধারিত চেয়ার ও কক্ষ জোরপূর্বক দখলে রাখারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্বশুর আওয়ামী লীগের আগৈলঝাড়া উপজেলা শাখার সদস্য বখতিয়ার শিকদারের রাজনৈতিক আশীর্বাদ এবং তৎকালীন সংসদ সদস্য হাসানাত আব্দুল্লাহর বিশেষ সুপারিশে তারিকুল ইসলাম হলুদ প্রথমে অস্থায়ীভাবে উপজেলা পরিষদে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে মালি পদে স্থায়ী নিয়োগের সুযোগ পেয়ে তিনি ধাপে ধাপে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্বের নিয়ন্ত্রণ নেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, অফিস সহকারীর জন্য নির্ধারিত অফিস কক্ষে চেয়ারে বসে রয়েছেন মালি পদে নিয়োজিত তারিকুল ইসলাম। তিনি কেবলমাত্র বসেই ছিলেন না, তার সামনে একটি ডেস্কে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সাজানো। সামনের চেয়ারে বসা দুইজন সেবাগ্রহীতা এবং পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরও একজনকে তিনি দাপ্তরিক ভাষায় নির্দেশনা ও সহায়তা প্রদান করছিলেন। তার আচরণ, শরীরী ভাষা ও কার্যক্রম দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি সেখানে একজন নিম্নপদস্থ কর্মচারী হিসেবে নয় বরং একজন প্রভাবশালী প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেই কার্যভার সামলাচ্ছেন। এমনকি তার ডেস্কে থাকা কম্পিউটারে সরকারি সফটওয়্যার খোলা ছিল এবং সেখানে জাতীয় তথ্যভান্ডার সংশ্লিষ্ট একটি ফর্ম সম্পাদনরত ছিলেন তিনি। অথচ বাস্তবতায় সরকারি কাগজপত্র অনুযায়ী তার পদমর্যাদা শুধু মাত্র একজন উদ্যান পরিচর্যাকারী বা মালি।
অফিস সহকারী পদে কর্মরত মতিউর রহমান মোল্লা অভিযোগ করে বলেন, সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও তিনি নিজের নির্ধারিত চেয়ারটি ব্যবহার করতে পারছেন না। তার স্থলে মালি পদে কর্মরত তারিকুল ইসলাম হলুদ ওই চেয়ারেই বসে অফিসের যাবতীয় কাজ পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
শুধু অফিসের চেয়ার দখলই নয় বরং ইউএনও অফিসের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ইচ্ছামতো দাপ্তরিক নথিপত্রে হস্তক্ষেপ এবং বয়স পরিবর্তনের নামে বাণিজ্য করেন তারিকুল ইসলাম হলুদ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সরকারি কর্মকর্তা জানান, তারিকুল ইসলাম হলুদ নিয়মিতভাবে ইউএনও কার্যালয়ের প্রশাসনিক ইউজার আইডি-পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে জন্মনিবন্ধনের তথ্য পরিবর্তন করছেন। যার একাধিক উদাহরণ সরকারি ওয়েবসাইটেই সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে দুটি পরিবর্তনের তথ্য সবচেয়ে দৃষ্টিকটু এবং প্রশ্নবিদ্ধ। যেখানে দেখা যায় এক ব্যক্তির প্রকৃত জন্মতারিখ ২ মার্চ ১৯৭৩ থেকে পরিবর্তন করে ৭ মার্চ ১৯৮২ করা হয়েছে। অর্থাৎ পুরো নয় বছর বয়স কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্ট ওই ব্যক্তির মেয়ের জন্মতারিখেও আনা হয়েছে কৌশলী পরিবর্তন। আগে যেখানে মেয়ের জন্মতারিখ ছিল ৫ জুলাই ১৯৮৫, সেটি সংশোধন করে ২ মার্চ ১৯৮৫ দেখানো হয়েছে অর্থাৎ চার মাস এগিয়ে আনা হয়েছে। এই দুইটি পরিবর্তনের ফলে এখন কাগজ অনুযায়ী বাবা ও মেয়ের বয়সের ব্যবধান দাঁড়িয়েছে মাত্র আড়াই বছরের মতো।
জানা গেছে, উপজেলার প্রায় পাঁচটি ইউনিয়ন থেকে প্রতিদিন ব্যাগভর্তি জন্মনিবন্ধন সংশোধনের আবেদন নিয়ে তারিকুল ইসলাম হলুদের হাতে সরাসরি জমা দেয় একটি সংঘবদ্ধ দালালচক্র। পরে নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে এসব আবেদনের যাচাই-বাছাই, তথ্য এন্ট্রি থেকে শুরু করে অনুমোদনের পুরো প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করেন তারিকুল ইসলাম হলুদ নিজেই।
সম্প্রতি পরিষদে আসা রনবীর দাস বলেন, আমার ছেলের বয়স এক বছর বাড়াতে ইউনিয়ন অফিসে গেলে আমাকে বলা হয় তারিকুল ইসলাম হলুদ সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু যোগাযোগ করতেই তিনি টাকা দাবি করেন।
একই ধরনের অভিজ্ঞতা আরও কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দারও। তাদের দাবি, বছরের পর বছর ধরে চলছে এই বয়স বাণিজ্য।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত তারিকুল ইসলাম হলুদ নিজেকে উপজেলা টেকনিশিয়ান দাবি করে বলেন, অফিস সহকারী কোনো কাজ না পারায় আমি তার চেয়ারে বসি। তাকে কেউ বসতে বারণ করে না। গত পাঁচ বছর যাবত কাজ না পারায় কোনো ইউএনওর আমলেই সে বসতে পারেনি। আমি শুধু ওই অফিস সহকারীর না, আমি সকল অফিস সহকারীর কাজ করি। তবে আমি কোনো ফাইলের কাজ করি না।
ব্যাগভর্তি জন্মনিবন্ধন সংশোধনের আবেদন তার হাতে আসা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বয়স সংশোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইডি স্যারের কাছে। কাজ তো আমি করি না, কাজ স্যার করেন।
এ বিষয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারিহা তানজিন বলেন, তারিকুল ইসলাম হলুদ মালি পদে চাকরি করেন। তিনি যদি কোনো অনিয়ম করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই সেটা খতিয়ে দেখা হবে। তাছাড়া অফিস সহকারী পদে কর্মরত মতিউর রহমান মোল্লা না পারে টাইপিং, না পারে কম্পিউটার চালাতে। সে নিজের রুম ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে পিয়নের সঙ্গে বসে থাকে।