খালিদ হোসেন মিলু, বদলগাছী (নওগাঁ) প্রতিনিধি: আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি ঘর। একসময় নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার বিভিন্ন এলাকার গ্রামগুলোতে মাটির তৈরি ঘরবাড়ি নজরে পড়লেও এখন এই ঘর নির্মাণে কারো তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। ফলে জেলার উপজেলার ৮টি ইউনিয়নেই মাটির বদলে ইট পাথরে নির্মিত ঘর বাড়ি জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। আর আধুনিকতার ছোঁয়া আর ইট পাথরের ভিড়ে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি ঘরবাড়ি।
জানা যায়, বহু বছর আগে থেকেই মানুষ মাটির ঘরে বসবাস করতে শুরু করেন। মাটির সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে বেশ আগ্রহী ছিলেন।
এঁটেল বা আঠালো মাটি কাদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে বাড়ির দেয়াল তৈরি করতেন তারা। ১২-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড় অথবা টিনের ছাউনি দেওয়া হতো। শুধু একতলাই নয়, অনেক সময় দোতলা পর্যন্ত তৈরী করা হতো মাটি ঘর। এসব মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের সময় লাগতো ৪৫ থেকে ৬০ দিন।
মাটির তৈরি ঘরের দেয়ালে সৌখিন গৃহিণীরা বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে তাদের নিজ-নিজ বসত ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। বর্তমানে ধনী কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা তাদের পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য মাটির ঘর ভেঙ্গে ইট-পাথর, লোহা, সিমেন্টের মিশ্রনে বিলাসবহুল বাড়ি বানানোর দিকে ঝুঁকছেন। যার যেমন সামর্থ্য তিনি সেইভাবে তৈরি করছেন ঝকঝকে সুন্দর বাড়ি।
মাটির তৈরি ঘর এখন চোখে আর না পড়লেও এটা মানতে হবে যে, এই ঘরগুলো শীত বা গরমে থাকার জন্য বেশ আরামদায়ক ছিল। মাটির ঘরে শীতের দিনে ঘর থাকে উষ্ণ আর গরমের দিনে শীতল। তাই মাটির ঘরকে গরিবের এসিও বলা হয়ে থাকে।
ইট-পাথরের ভিরে এখন আর তেমন চোখে পড়ে না গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য। কারিগররাও এখন এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তারা এখন কৃষি জমিতে শ্রম বিক্রি করছেন। আবার কেউ কাজ না পেয়ে স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে আগাম শ্রম বিক্রিও করছেন।
উপজেলার প্রবীণ ব্যাক্তিরা জানান, মাটির তৈরি ঘর আরামদায়ক। দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি বিত্তবানরাও একসময় পরিবার-পরিজন নিয়ে মাটির তৈরি বাড়িতে বসবাস করতেন। বৃষ্টি বা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হলে এসব ঘর অনেক বছর পর্যন্ত টিকে থাকতো।
উপজেলার সোহাসা গ্রামের মোস্তাকিম বলেন, অনেক আগে তৈরী আমাদের মাটির বাড়ি আর সেই মাটির ঘরে এখন পর্যন্ত পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। ইটের ঘর থাকলেও আমি এখনো সেই গরীবের এসি খ্যাত মাটির ঘরেই থাকি - মাটির ঘরে আলাদা একটা প্রশান্তি পাওয়া যায়।
বর্তমানে মানুষ আধুনিক জীবন যাপনের ইচ্ছা ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে সবাই মাটির ঘর ভেঙ্গে টিন আর ইটের পাকা বা সেমিপাকা ও বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেছেন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর এখন বিলুপ্ত হতে চলেছে।
বদলগাছী উপজেলার বিলাশবাড়ী ইউনিয়নের দুধকুড়ি গ্রামের হায়াৎ হোসেন বলেন, বহু বছর আগে এই মাটির বাড়ি নির্মাণ করেছিল আমার দাদা। আমরা পরিবারের সবাই এখনো মাটির তৈরি দোতালা বাড়িতেই বসবাস করি। শীতে সময় গরমের অনুভূতি আর গরমের সময় শীতল থাকে এই মাটির বাড়ি।এই উপজেলায় আজও বেশ কিছু মাটির ঘর রয়েছে।
কোলা ইউনিয়নের আইজুল জানান, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা বাপ-দাদার তৈরি মাটির ঘর প্রতি বছর কিছুটা মাটি দিয়ে সংস্কার করে আজও বসবাস করছেন। তবে মাটির ঘর গুলো খুব আরামদায়ক।
বদলগাছী উপজেলার জিয়া সাইবার ফোর্সের সভাপতি বলেন, মথুরাপুর এলাকায় এখনো দৃষ্টি নন্দন বাড়ির দেখা যায়। অনেকেই আবার বাপ-দাদার রেখে যাওয়া মাটি বাড়ি সংস্কার করে সেই মাটির ঘরে আজও বসবাস করছেন। আমাদের উপজেলায় খুব কম মাটির ঘর দেখা যায়। আধুনিকতা ছোঁয়ায় এখন মাটির তৈরি ঘর বিলুপ্তির পথে। মানুষের অর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে জীবন মানেরও অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এতে হারিয়ে যেতে বসেছে চিরচেনা মাটির তৈরী ঘরের ঐতিহ্য।