রিজওয়ানা ছিলেন বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা ব্যুরো বাংলাদেশের সিনিয়র ম্যানেজার। বিদেশে স্বামীর পদায়নের কারণে চাকরি ছাড়তে হয় তাকে। তিন বছর পর আবার কর্মজীবনে ফিরতে চান তিনি। কিন্তু চাকরির বাজারে ঘুরে দেখেন তার জন্য চাকরি নেই।
রিজওয়ানার ভাষ্যমতে, বাজারে চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো নয়। চাকরিতে বিরতির পর কোথাও জীবনবৃত্তান্ত দিলে সাক্ষাৎকারে প্রথম প্রশ্ন থাকে, ‘আপনি এতদিন ব্রেকে ছিলেন, সব তো ভুলে গেছেন।’
‘আমাদের চাকরিদাতাদের মানসিকতা অনেক বড় ব্যাপার। তাদের একটু এগিয়ে আসা দরকার। আমরা তো কাজ করেছি, স্কিল আছে। সুযোগটা দেওয়া প্রয়োজন। আমি তো পারিবারিক সমস্যা কাটিয়ে উঠেছি এবং নিজেকে প্রস্তুত করেছি।’ বলছিলেন রিজওয়ানা।
রিজওয়ানা বলেন, ‘পরিবার থেকেও বিভক্ত প্রতিক্রিয়া এসেছে। পরিবারে দুই ধরনের লোক আছে। অনেকে চান না আমি আবার ফিরি। আবার কেউ কেউ বুলিংও করছেন।’
মনিষা দেব বর্মণ ২০১৮ সাল থেকে ব্র্যাকের মাইক্রো ফাইন্যান্স প্রগতি বিভাগে কাজ করতেন। সন্তান হওয়ায় সেই চাকরি ছেড়ে তিন বছর ছয় মাসের বিরতি নেন। এখন কর্মক্ষেত্রে ফিরতে চাইলেও নানান অজুহাতে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাকে।
মনিষার ভাষ্যমতে, বাচ্চার কারণে চাকরি ছেড়েছি। এজন্য তারা বলে— ‘আপনি এখন আর ইফিশিয়েন্ট নন। বাচ্চাকে নিয়ে যে কোনো সমস্যা হতে পারে, তখন কী হবে?’
মনিষা বলেন, “মাইক্রোফাইন্যান্স ছাড়া অন্য কোথাও যেতে চাইলেও নিচ্ছে না। তারা বলে— ‘আপনি একটা বাচ্চার কারণে জব ছেড়ে দিয়েছেন, আরেকটা বাচ্চা হলেও তো আবার ছেড়ে দেবেন।’ তখন আবার আমাদের নতুন লোক নিতে হবে। তাই আপনাকে না নেওয়াই বেটার’।”
শারমিন আক্তার বৃষ্টি কাজ করতেন সিপিডিতে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়। তিনি বলেন, ‘আমার উচ্চ ডায়াবেটিস ছিল, আর বাসা থেকে অফিসও ছিল অনেক দূরে। সিনিয়র সহকর্মীরা সমস্যা বুঝে সহজেই চাকরি ছাড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।’
চাকরির ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এখন আবার ফিরে আসার পথে বড় বাধা দেখছেন শারমিন। বলেন, “বাচ্চার জন্য ডে কেয়ার পাওয়া কঠিন। চাকরিদাতারাও জিজ্ঞেস করেন— ‘এক বছরের বাচ্চা রেখে আপনি পারবেন?’ আসলে আমাদের দুই পক্ষকেই এ পরিবেশটা দিতে হবে।”
চাকরিতে বিরতির পর শ্রমশক্তি থেকে ছিটকে পড়ছে নারীরা
একইভাবে সাদিয়া সিদ্দিকা কাজ করতেন ব্র্যাকে। মা হওয়ার পরে ২০২৩ সালে চাকরি ছাড়েন। এখন ফিরতে চান। কিন্তু তার ভাষ্য, ‘যে অবস্থান থেকে চাকরি ছেড়ে আসছি, আবার সেখানে ফেরা খুব কঠিন।’
এটা রিজওয়ানা, মনিষা, শারমিন ও সাদিয়ার শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয় বরং শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কমার নিয়মিত চিত্র। কয়েক বছর ধরে পুরুষের তুলনায় নারীদের শ্রমশক্তি বেশি কমছে।
শ্রমশক্তি জরিপের চিত্র
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের শ্রমশক্তির সংখ্যা ৭ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার। আগের বছর ২০২৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে শ্রমশক্তি কমেছে প্রায় ১৭ লাখ ৪০ হাজার।
এই সময়ে পুরুষ শ্রমশক্তি কমেছে প্রায় এক লাখ এবং নারী শ্রমশক্তি প্রায় ১৬ লাখ ৪০ হাজার। ২০২৩ সালে শ্রমশক্তিতে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৮১ লাখ ২০ হাজার, আর নারী ছিল ২ কোটি ৫৩ লাখ ৩০ হাজার।
২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পুরুষ শ্রমশক্তি বেড়েছে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার। বিপরীতে একই সময়ে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার। ২০২২ সালে নারীর শ্রমশক্তি ছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ ৮০ হাজার, যা দুই বছরে নেমে এসেছে ২ কোটি ৩৬ লাখ ৯০ হাজারে।
শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারেও নারী অনেক পিছিয়ে। ২০২৪ সালে পুরুষের অংশগ্রহণের হার ৭৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ হলেও নারীদের হার মাত্র ৩৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৪২ দশমিক ৭৭ শতাংশ— অর্থাৎ মাত্র দুই বছরে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে প্রায় ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
শ্রমশক্তির বাইরে নারীর সংখ্যা বেড়েছে
শ্রমশক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বছর বছর বাড়ছে। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা বাড়ছে আরও বেশি। বিবিএসের জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে শ্রমশক্তির বাইরে ছিল ৪ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার জন। ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয় ৪ কোটি ৭১ লাখ ৭০ হাজার জন এবং ২০২৪ সালে হয় ৫ কোটি ৪০ হাজার জন।
২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের ব্যবধানে শ্রমশক্তির বাইরে নারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৩ লাখ ৭০ হাজার, যেখানে পুরুষ বেড়েছে ৫ লাখ। ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের ব্যবধানে নারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১১ লাখ ৪০ হাজার।
কাজে নিয়োজিতদের মধ্যে ২০২৪ সালে পুরুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৬২ লাখ ২০ হাজার এবং নারীর সংখ্যা ২ কোটি ২৮ লাখ ৭০ হাজার। অর্থাৎ, পুরুষের তুলনায় নারীর কর্মসংস্থান প্রায় অর্ধেক।
নারীরা কেন কর্মজীবন ছাড়ছেন
বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে প্রতি চারজন নারীর মধ্যে একজন কর্মস্থলে আর ফিরে যেতে পারেন না। এর মূল কারণগুলো হলো—
সমাধানের উপায়
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—রাষ্ট্র, পরিবার ও সমাজের সম্মিলিত সহযোগিতার মাধ্যমে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের বিস্তৃত ব্যবস্থা, নিরাপদ পরিবহন, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ; এসব নিশ্চিত করলে নারীকর্মী চাকরিতে স্থায়ীভাবে ফিরে আসতে এবং পেশাজীবনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।
ব্র্যাকের পিপল কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশনের ঊর্ধ্বতন পরিচালক মৌটুশি কবির বলেন, কর্মজীবন থেকে বিরতি নেওয়া নারীদের জন্য ডে কেয়ার ব্যবস্থা খুবই জরুরি। ব্রিজ রিটার্নশিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে এসব নারীর কর্মজীবনে ফেরার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি শুধু নারীদের নয়, তাদের সন্তানদেরও দীর্ঘমেয়াদি উপকার করবে। আমাদের লক্ষ্য হলো পরিবার ও পেশাজীবনের ভারসাম্য বজায় রেখে নারীদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা।
স্কয়ার ফুড ও বেভারেজ লিমিটেডের মানবসম্পদ প্রধান মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান বলেন, নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা ও নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করলে নারীরা কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে। প্রয়োজন হলে ওয়ার্ক ফ্রম হোম ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। নারীরা সঠিক পরিবেশ পেলে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, সন্তান পালনসহ সংসারের সব কাজ সমানভাবে ভাগ করা উচিত। আমাদের প্রচলিত ধারণায় সব দায়িত্ব নারীর ওপর চাপানো হয়, যার ফলে নারীরা কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র সব জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা। এটি না হলে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব নয়।