দক্ষিণ এশিয়া এখন সার্বভৌম ঋণ (সোভারিন ডেবট) এবং রাজস্ব ঘাটতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে। এ অঞ্চলের সরকারি ঋণ অন্যান্য উদীয়মান অর্থনৈতিক অঞ্চলের তুলনায় অনেক দ্রুত বেড়েছে। এর মূল কারণ ধারাবাহিক বাজেট ঘাটতি। ২০২৩ সালের মধ্যে সরকারি ঋণের পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৭৭ শতাংশে পৌঁছায়। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা সার্বভৌম ঋণ খেলাপি হয়ে যায়। আর ২০২৩ সালে পাকিস্তান অল্পের জন্য একই পরিস্থিতি এড়ায়। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তা চাইতে বাধ্য হয়, যা ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মজুদের সংকটের গভীরতাকে প্রকাশ করে। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতও ৮০ শতাংশ সরকারি ঋণের ভার বহন করছে। আর নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের মতো ছোট অর্থনীতিগুলো টিকে আছে মূলত রেয়াতি (কনসেশনাল) অর্থায়নের ওপর নির্ভর করে।
এই উচ্চ ঋণস্তর এবং এর দুর্বলতা কেবল এর পরিমাণে নয়, কাঠামোগত দিকেও নিহিত। একদিকে সীমিত কর-ভিত্তি, অদক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং আমদানিনির্ভর জ্বালানি ও পণ্যের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা রাজস্ব ব্যবস্থাকে সংকুচিত করছে। অন্যদিকে সীমিত বাণিজ্য সংহতি ও আঞ্চলিক সহযোগিতার অভাব দক্ষিণ এশিয়াকে বহিঃনির্ভরশীল করে তুলছে। এর ফলে উন্নয়ন অগ্রাধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য অর্থ বরাদ্দ কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আর্থিক অগ্রাধিকার পুনর্গঠিত হচ্ছে, আর জনঅর্থায়ন নাগরিকদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বহিরাগত ধাক্কা
কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধির নড়বড়ে ভিত্তিকে উন্মোচিত করেছে।
২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এর ফলে আমদানি ব্যয় বাড়ে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়। রিজার্ভ সংকট সামাল দিতে সরকারগুলো আরও ঋণ নেয়, যাতে দেশ চালু রাখা যায় এবং মৌলিক প্রয়োজন (জ্বালানি ও পণ্য) আমদানি অব্যাহত থাকে। ফলে দ্রুত মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়- যা সরবরাহ আধিক্যের কারণে নয়, বরং আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়া এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের বিঘ্নের কারণে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় ভোক্তা পণ্যের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়, ২০২৩ সালে পাকিস্তানে ৩০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। এমনকি ‘এশিয়ার বাঘ অর্থনীতি’ নামে পরিচিত বাংলাদেশেও ২০২৫ সালে মুদ্রাস্ফীতি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ভারতের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে বহুমুখী ও স্থিতিশীল হলেও, রাশিয়ার সঙ্গে ছাড়মূল্যের জ্বালানি চুক্তি সত্ত্বেও ৩ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি ধরে রাখতে সরকারকে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার লাখো মানুষ এখন প্রতিটি বৈশ্বিক সংকটের অভিঘাত প্রথমে টের পায় জ্বালানি পাম্পে বা বাজারের দোকানে। এর ওপর যুক্ত হয়েছে নতুন বাণিজ্য বাস্তবতা।
২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র, যা দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ টেক্সটাইল ক্রেতা, ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসায় পোশাক ও শ্রমনির্ভর পণ্যের ওপর। এতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, শ্রীলঙ্কার অ্যাপারেল ও ভারতের টেক্সটাইল রপ্তানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই শুল্ক আরোপ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্য বড় আঘাত। কারণ তারা ঋণ শোধের জন্য রপ্তানি আয়ের ওপর নির্ভর করে। ফলে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমে যায় এবং বিদ্যমান কাঠামোগত সমস্যাগুলো আরও ঘনীভূত হয়।
কাঠামোগত সমস্যা
দুর্বল রাজস্ব ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় হলেও অকার্যকর ভর্তুকি নীতির কারণে সরকারগুলো বহিরাগত ধাক্কা সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানে কৃত্রিমভাবে কম বিদ্যুৎ ট্যারিফ নির্ধারণ ‘চক্রাকার ঋণ’ তৈরি করেছে, যা বারবার সরকারি হিসাবপত্রে ফিরে আসে। রাজস্ব কম থাকায় সরকারকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অবকাঠামোর মতো খাত থেকে অর্থ সরিয়ে এই ভর্তুকি বহন করতে হয়। এ ধরনের ভর্তুকি অর্থনৈতিক দক্ষতার জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুর্বল করভিত্তিও বড় সমস্যা। ২০২৪ সালে পাকিস্তানে মাত্র ৩ শতাংশ নাগরিক আয়কর দিয়েছে, বাংলাদেশে ২০২২ সালে ১.৪ শতাংশ, আর ভারতে ৭ শতাংশ। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জ্বালানি কোম্পানিগুলো নিয়মিতভাবে সরকারকে ক্ষতির মুখে ফেলছে। এসব কেবল অর্থনৈতিক অদক্ষতা নয়, বরং নীতিগত ব্যর্থতার ফল। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি প্রায়ই স্বল্পমেয়াদি জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটে। ফলে রাজস্ব শৃঙ্খলা দুর্বল হয়, সংকটে সরকারের প্রতিক্রিয়া ক্ষমতা কমে এবং পুনরুদ্ধার বিলম্বিত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন: নতুন চ্যালেঞ্জ
জলবায়ু পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার নাজুক রাজস্ব অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলছে। এই অঞ্চল বন্যা, তাপপ্রবাহ ও অস্বাভাবিক মৌসুমি বৃষ্টিপাতের মতো জলবায়ুগত বিপর্যয়ের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এসব দুর্যোগ ফসল, জীবিকা, বসতি ও অবকাঠামো ধ্বংস করছে। ২০২২ সালে পাকিস্তানের ভয়াবহ বন্যায়ই শুধু ৩০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয় এবং লাখো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে বাড়তি তাপমাত্রার কারণে বছরে প্রায় ২.৫ কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়, যার অর্থমূল্য ১.৮ বিলিয়ন ডলার। ভারত, নেপাল ও ভুটানে জলবিদ্যুৎ ব্যাহত হচ্ছে। আর শীতলীকরণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি আমদানি ও সরকারি ব্যয় বাড়ছে। এই জলবায়ু আঘাত নতুন ঋণ সৃষ্টি করছে। কারণ অভিযোজন অর্থায়ন প্রায়ই ঋণভিত্তিক। ফলে দেশগুলো টিকে থাকার জন্য আরও ঋণ নিচ্ছে, যা আর্থিক চাপ বাড়াচ্ছে- অথচ ঝুঁকি হ্রাস খুব সামান্যই হচ্ছে। এই ‘জলবায়ু-ঋণ ফাঁদে’ দেশগুলো দুইবার শাস্তি পায়। প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, পরে ঋণের বোঝা টেনে। পর্যাপ্ত রেয়াতি অর্থায়নের অভাবে রাজস্ব স্থিতিশীলতা জলবায়ু চক্রের হাতে বন্দি থাকবে। ‘ঋণ-বিনিময়ে জলবায়ু রেহাই’ বা ‘ঝুঁকি-তহবিল’-এর মতো পদক্ষেপ এর সময়োপযোগী সমাধান দিতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক বাধার কারণে আঞ্চলিক সহযোগিতা ধীরগতির।
সংকট ব্যবস্থাপনা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ডিফল্ট এড়াতে বারবার আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। ভারত শ্রীলঙ্কাকে ৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয় এবং নিজেও ২০২৩ সালে ১.৭ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা পায়, যা মুদ্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে, কিন্তু ঋণ এখনও অস্থিতিশীল। পাকিস্তান ২০২৩ সালে ৩ বিলিয়ন এবং ২০২৪ সালে আরও ৭ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পায়, যা মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু ঋণ পরিশোধেই সরকারের রাজস্বের ৬০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। বাংলাদেশ ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের কর্মসূচি নিয়েছে বৈদেশিক ঘাটতি ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পুনরুদ্ধার ধীরগতির। ছোট অর্থনীতির দেশ নেপাল ও ভুটান রেমিট্যান্স, সাহায্য ও রেয়াতি ঋণের ওপর নির্ভর করছে। এর ফলে আইএমএফ কর্মসূচিগুলো সময় কিনে দিয়েছে, সংকটের সবচেয়ে খারাপ সময়গুলো সামাল দিয়েছে। কিন্তু এখন দেশগুলোর উচিত এই সুযোগে আর্থিক শৃঙ্খলা পুনর্গঠন করা এবং ঋণনির্ভরতা কমানো।
পথচলার দিকনির্দেশ
মধ্য মেয়াদে দক্ষিণ এশিয়াকে এমন একটি আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক কাঠামো তৈরি করতে হবে যা পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে তোলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ভুটান, নেপাল ও ভারতের মধ্যে আঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্য বাড়ানো গেলে ২০৪০ সালের মধ্যে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব। ২০২২ সালে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৩ বিলিয়ন ডলার, যেখানে সম্ভাবনা ছিল অন্তত ৬৭ বিলিয়ন পর্যন্ত। এছাড়া ক্যারিবীয় অঞ্চলের জলবায়ু ঝুঁকি বীমা তহবিলের আদলে দক্ষিণ এশিয়াও একটি যৌথ ঝুঁকি বীমা তহবিল গঠন করতে পারে, যা দুর্যোগের পর নতুন ঋণ ছাড়াই দ্রুত নগদ সহায়তা দিতে পারবে। স্বল্প মেয়াদে, দেশগুলোকে নিজস্ব সংস্কার আনতে হবে- করভিত্তি প্রসারিত করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেয়া ভর্তুকি বন্ধ করা এবং লোকসানি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা। জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাজার দরে সমন্বয় করা। তবে নিম্ন-আয়ের জনগণের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা, এটি আর্থিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক হতে পারে। একই সঙ্গে বাজেট পরিকল্পনা, ঋণ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু ঝুঁকি অন্তর্ভুক্ত করে স্বচ্ছ আর্থিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করা জরুরি। নতুন ঋণ যেন রাজনৈতিক খরচে নয়, বরং উৎপাদনশীল বিনিয়োগে ব্যবহৃত হয়- এটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
(লেখক- বিজ্ঞান বাবু রেগমি একজন অর্থনীতিবিদ, এটিএইচ জুরিখ, সুইজারল্যান্ড এবং শিশির ভাণ্ডারি একজন অর্থনীতিবিদ, নিউইয়র্ক; জলবায়ু অর্থায়ন ও সার্বভৌম ঋণ বিশেষজ্ঞ। তাদের এ লেখাটি কাঠমাণ্ডু পোস্ট থেকে অনুবাদ)