ঢাকা
২৫শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
দুপুর ২:৫৬
logo
প্রকাশিত : মে ২৫, ২০২৫

শুরুতেই বড় বাণিজ্যের আয়োজন

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে বড় প্রকল্প ‘হায়ার এডুকেশন অ্যাকসেলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (হিট)’। কিন্তু চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে বড় ধরনের বাণিজ্যের আয়োজন চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে রিসার্চ ফান্ডের জন্য প্রথম পর্যায়ে ছাড়ের অপেক্ষায় থাকা প্রায় ৬০০ কোটি টাকার মধ্যে ১০০ কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারার আয়োজন করেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠেছে, রিভিউয়ারদের ম্যানেজ করে আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের কাজ দেওয়ার নীলনকশা চূড়ান্ত করেছে ওই সিন্ডিকেট।

এরই মধ্যে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক উপাচার্য।

সূত্র জানায়, ইউজিসি বাস্তবায়নাধীন ‘হিট’ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের অর্থের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ ২০২৩ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ১৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।

মোট ব্যয়ের মধ্যে দুই হাজার ৩৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকার এবং এক হাজার ৯৮৩ কোটি ১১ লাখ টাকা বিশ্বব্যাংক বহন করবে।

জানা যায়, হিট প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) নিয়োগ পরীক্ষায় ৩২ প্রার্থীর মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হাসনাত মুহাম্মদ সোলায়মান। গত বছরের ১৪ মার্চ ইউজিসি তাঁকে নিয়োগ দেয়। কিন্তু ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের মৌখিক নির্দেশে মাত্র এক দিনের মাথায় তাঁর নিয়োগ বাতিল করে মন্ত্রণালয়।

পরে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) আওয়ামী লীগপন্থী অধ্যাপক আসাদুজ্জামানকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া এই প্রকল্পে অন্যতম পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোজাহার আলী। তাঁরা দুজন এখনো বহাল রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই প্রকল্পের অন্যতম কম্পোনেন্ট শিক্ষকদের গবেষণা প্রকল্প। প্রায় ৩০০ প্রকল্পে ৬০০ কোটির বেশি টাকা ছাড়ের অপেক্ষায় রয়েছে।

বর্তমানে গবেষণার প্রকল্প প্রস্তাব মূল্যায়ন করছেন রিভিউয়াররা। প্রতিটি গবেষণা দুজন রিভিউয়ার রিভিউ করবেন। এরপর সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত ৩০০টি প্রকল্প চূড়ান্ত করা হবে। প্রতিটি গবেষণার জন্য দুই কোটি টাকার কমবেশি ফান্ড দেওয়া হবে।
অভিযোগ উঠেছে, পিডি যেহেতু সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের নির্দেশে নিয়োগ পেয়েছেন, স্বাভাবিকভাবে তিনি আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের প্রাধান্য দিচ্ছেন। এ জন্য ইউজিসি ও হিট প্রকল্পের পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাঁরা শতাধিক রিভিউয়ারকে ম্যানেজের অভিযানে নেমেছেন। প্রত্যেক রিভিউয়ের জন্য ১৫ হাজার টাকা সম্মানী রাখা হলেও সর্বোচ্চ নম্বর দিলে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্যদিকে যেসব গবেষণা প্রকল্পে সর্বোচ্চ নম্বর দেওয়া হবে, তাদের সঙ্গে ফিফটি-ফিফটির মৌখিক চুক্তি হয়েছে। অর্থাৎ দুই কোটি টাকার প্রজেক্ট পেলে এক কোটি টাকা দিয়ে দিতে হবে। আবার কোনো ক্ষেত্রে এর কমবেশিরও রয়েছে। এভাবে শতাধিক গবেষণা প্রকল্পে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে ১০০ কোটি টাকা বাণিজ্যের আয়োজন করেছে ওই সিন্ডিকেট।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলিমুল ইসলাম বলেন, ‘হিট প্রকল্পের রিভিউয়ার সিলেকশনের জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন এক্সপার্ট চাওয়া হয়েছিল। আমরা আমাদের ট্রেজারারকে পাঠাই। কৃষির প্রজেক্টগুলোর জন্য এ রকম ছয়জন এক্সপার্ট মিটিংয়ে যান। গিয়ে দেখেন ড. মোজাহার আলী ২৫০ রিভিউয়ারের তালিকা নিজেই করে এনেছেন। তাঁদের বেশির ভাগই বিতর্কিত। পরে এক্সপার্টরা সেই তালিকা থেকে বেশ কিছু নাম কেটে দিয়ে যোগ্যদের নাম তালিকাভুক্ত করেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, মোজাহার আলীর তালিকা অনুযায়ীই রিভিউয়ার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে বোঝা যায়, কিছু একটা হচ্ছে। এখন যে মূল্যায়ন হয়েছে, সেটা অবশ্যই বিতর্কিত। আমরা ব্যাপারটি ইউজিসি চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি।’

সূত্র জানায়, হিট প্রকল্পের ওই সিন্ডিকেট দরপত্রের ক্ষেত্রে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে বড় অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি অ্যাক্টিভ নেটওয়ার্ক উপাদান সরবরাহের একটি দরপত্রে দুটি প্রতিষ্ঠানের দর প্রায় কাছাকাছি। তবে দরদাতার প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট পেশাদার (পিএমপি) সার্টিফায়েড কর্মী থাকতে হবে। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানের তা না থাকলেও তাদেরই কাজ দেওয়ার ব্যাপারটি প্রায় চূড়ান্ত। ওই কম্পানির লিড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যাঁর নাম দেওয়া হয়েছে, তিনি বর্তমানে টাইগার আইটি বাংলাদেশে কর্মরত, যা দরপত্রের শর্তের মধ্যে পড়ে না। তারা মূলত ওই কাজ পেলে অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দেবে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ ব্যাপারে হিট প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘রিভিউয়ারসহ অন্য ব্যাপারগুলো ইউজিসি দেখছে। আপনাদের কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে তাদের কাছ থেকেই জেনে নিতে পারেন।’

৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পিডি পদে নিয়োগ ফিরে পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন প্রথম নিয়োগ পাওয়া অধ্যাপক হাসনাত। সেখানে তিনি বলেন, ‘শুধু আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুসারী না হওয়ায় তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের মৌখিক নির্দেশে সরকারি ছুটির দিনে আমার জিও বাতিল করা হয়। কিন্তু আইন ও নিয়ম অনুযায়ী আদেশ বাতিল করতে হলে আন্ত মন্ত্রণালয় সভা করতে হয়। সেটির তোয়াক্কা না করে বেআইনিভাবে তড়িঘড়ি করে আমার নিয়োগ বাতিল করা হয়, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। আমার একমাত্র অপরাধ ছিল আমার চাকরি শুরু ২০০৬ সালের ৩০ মে। এ ছাড়া আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদা দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’

বঞ্চিত প্রার্থী অধ্যাপক হাসনাতের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসির মতামত চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী গত বছরের ২৫ নভেম্বর ইউজিসি থেকে মতামত দেওয়া হয় যে আবুল হাসনাত মুহাম্মদ সোলায়মান অন্যায্যতার শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর ন্যায্যতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের সভাপতিত্বে হিট প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ কমিটির সভা হয়। ওই সভায় বেশির ভাগ সদস্য পিডি পরিবর্তন করে অধ্যাপক হাসনাতকে নিয়োগের বিষয়ে মত দেন। প্রকল্পটির গতি ধীর বলেও সভায় তুলে ধরা হয়।

এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইউজিসিকে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে পিডি পরিবর্তনের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের মতামত নিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই মতামত আর মন্ত্রণালয়কে জানায়নি ইউজিসি। তারা এখন অনেকটাই চুপ রয়েছে।

ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘রিভিউয়ারের ব্যাপারে কিছু কথা ওঠার পর আমরা সবার সঙ্গেই কথা বলেছি। আমি শুধু এটুকু বলব, আমরা শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে চাই। এ জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করব। কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আমরা আপস করব না।’

বর্তমান পিডির ব্যাপারে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যাপারে স্যাটিসফায়েড। বিশ্বব্যাংকও স্যাটিসফায়েড। আগে যিনি পিডি নিয়োগ পেয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে রিট হয়েছে। এখন আদালত যদি তাঁকে নিয়োগ দিতে বলেন, অবশ্যই আমরা গ্রহণ করব।’

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram