আজ বাংলা নববর্ষ। বাঙালির ঐতিহ্য এ নববর্ষ এখন পান্তা-ইলিশের দিন হিসেবে পরিচিত। তবে অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির ফলে বর্ষবরণে ইলিশ এখন মধ্য ও নিম্নবিত্তের পাতে সহজে উঠছে না।
অথচ পদ্মা নদীর রাজশাহীর কিংবা গোয়ালন্দ অংশে একসময় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মিলত।
এত ইলিশ পাওয়া যেত যে খাওয়ার লোক ছিল না। ফলে ইলিশের পচা গন্ধ থেকে বাঁচতে জেলেরা তা মাটিতে পুঁতে রাখতেন। তাঁরা ইলিশের শুঁটকিও তৈরি করতেন। ফরিদপুর-পাবনা হয়ে রাজশাহীর পদ্মায় প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ত ৭০ থেকে ৮০ বছর আগে।
কিন্তু এখন মাঝে মাঝে ছোট ছোট জাটকা ছাড়া বড় ইলিশের আর দেখা পাওয়া যায় না। খুলনা বা বরিশাল থেকে বাসে বা ট্রাকে করে রাজশাহীর আড়তে যে সামান্য ইলিশ আসে, সেটার ওপরই নির্ভর করতে হয় উচ্চবিত্ত ভোজনরসিকদের। পদ্মায় ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে নদীতে স্রোত কমে যাওয়ায় এখন আর ইলিশ মেঘনা থেকে রাজশাহীর পদ্মায় তেমন আসে না বলে দাবি করেছেন অভিজ্ঞরা।
রাজশাহীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রাজশাহীর বাজারে গতকাল রবিবার এক কেজি বা তার চেয়ে একটু বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত।
দিন কয়েক আগেও এটি ছিল এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা কেজি। তিন বছর আগে এই সময় এক কেজি ওজনের ইলিশ রাজশাহীতে পাওয়া গেছে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা দরে। দেড় কেজি সাইজের ইলিশ পাওয়া যেত এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা কেজি দরে। এখন সেখানে দুই হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে এই তিন বছরে গড়ে অন্তত ৬০০ টাকা কেজিতে বেড়েছে ইলিশের দাম।
গতকাল রবিবার রাজশাহীর বিভিন্ন বাজারে ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশও বিক্রি হয়েছে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা কেজি দরে। কিছুদিন আগে এই ওজনের ইলিশ বিক্রি হতে দেখা গেছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজি দরে।
গতকাল রাজশাহীর নিউমার্কেটের পাশে আড়তে খুচরা দোকানে ইলিশ কিনতে এসেছিলেন মাজেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এ বছর ইলিশ এক দিনও কিনতে পারিনি। বর্ষবরণের দিন ইলিশ খাব বলে কিনতে এলাম। কিন্তু দাম এত বেশি যে কেনার সাধটাও যেন হারিয়ে গেল।’
খুচরা ইলিশ বিক্রেতা আলাউদ্দিন বলেন, ‘এখন ইলিশ তেমন আসে না। এলেও বেশি দামের কারণে তেমন ক্রেতা পাওয়া যায় না। সারা দিন বসে থেকে ৫০ জন ক্রেতা পাওয়া দায় হয়ে যায়।’
এদিকে রাজশাহীর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে গত বছরের অক্টোবরে ইলিশ কেটে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। কয়েক দিন এভাবে বিক্রিও করতে দেখা গেছে। কিন্তু ২৫০ গ্রামের নিচে কাটা ইলিশ বিক্রি না হওয়ায় ক্রেতারা কয়েক দিন পরই মুখ ফিরিয়ে নেন। ফলে কাটা ইলিশ বিক্রিও বন্ধ হয়ে যায় মাস না পেরোতেই।
সাহেববাজারের ব্যবসায়ী আজমত হোসেন বলেন, ‘বছর বিশেক আগেও আমরা রাজশাহীর পদ্মার ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাঝে মাঝে বিক্রি করেছি। এখন ওই ওজনের ইলিশ আর পদ্মায় পাওয়া যায় না। বর্ষায় জাটকা কিছু জেলেদের জালে আসে।’
গোয়ালন্দেও পদ্মার ইলিশের আগের দৃশ্য দেখা যায় না। উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের বাহিরচর গ্রামের জেলে পরান হালদার বলেন, ‘গোয়ালন্দে পদ্মা নদীতে এখন আর আগের মতো ইলিশ নেই। সারা দিন জাল বেয়ে হাতে গোনা কিছু ইলিশ পাওয়া যায়। তবে ইলিশ ধরতে গিয়ে বাঘাইড়, কাতল, পাঙ্গাশসহ ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়ছে।’
গোয়ালন্দ পৌর শহরের মাছের আড়তদার বাদল বিশ্বাস জানান, গোয়ালন্দের পদ্মায় ইলিশ নেই বললেই চলে। তাই বরিশাল থেকে ইলিশ মাছ এনে গোয়ালন্দ উপজেলা এলাকার ইলিশের চাহিদা মেটানো হচ্ছে।
দৌলতদিয়া ৫ নম্বর ফেরিঘাট এলাকার মাছ ব্যবসায়ী শাজাহান শেখ বলেন, ‘প্রতিবছরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে পদ্মা নদীর ইলিশের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু জেলেদের জালে সামান্য পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ছে। পদ্মা নদীর ইলিশসহ সব মাছের দাম অনেকটা বেশি। গতকাল সকালে দৌলতদিয়া ঘাটের হালিম সর্দারের আড়ত থেকে নিলামে দুটি ইলিশ কিনেছি। এর মধ্যে একটির ওজন এক কেজি ৭০০ গ্রাম, অন্যটির ওজন এক কেজি ৬০০ গ্রাম। চার হাজার ৩০০ টাকা কেজি দরে ওই দুটি ইলিশ কিনেছিলাম। পরে সামান্য লাভে মাছ দুটি ময়মনসিংহের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছি।’