সম্প্রতি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন জেফ বেজোস ও লরেন স্যানচেজ। বলা হচ্ছে বেজোস দম্পতির বিয়ে এই দশকের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিবাহগুলোর একটি। এর ধারাবাহিকতায় আমাদের আজকের আয়োজন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কিছু বিয়ে নিয়ে। ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন জামিউর রহমান
জেফ বেজোস ও লরেন স্যানচেজের বিয়ে
মিস্টার ও মিসেস বেজোস-জেফ বেজোস ও লরেন স্যানচেজের বিয়ে ২০২৫ সালের ২৭ জুন ভেনিসে অনুষ্ঠিত হয়, যা ‘সেঞ্চুরির বিয়ের’ মর্যাদায় পরিণত হয়েছে। তিন দিনব্যাপী এই আয়োজনে প্রায় ২০০-২৫০ জন উচ্চ সম্মানিত অতিথি- হলিউড তারকা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতির বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। যেমন : অপরা উইনফ্রে, বিল গেটস, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, টম ব্র্যাডি, কিম ও রেহ্যান কার্দাশিয়ান, খ্লো অ্যান্ড ক্যান্ডেল কার্দাশিয়ান–জেনার, ইভা লংগোরিয়া, কুইন রানিয়া ইত্যাদি।
খরচের বিষয়ে স্থানীয় সরকার এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে পরিমাপ অনুযায়ী, সম্পূর্ণ আয়োজনের ব্যয় হয়েছে ৪০-৪৮?মিলিয়ন ইউরো, যা ডলারে ৪৭-৫৬ মিলিয়ন ইউএসডি সমতুল্য। তবে কিছু বিশ্লেষক এটিকে ‘মোডেস্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেছে- বেজোসের বিশাল সম্পদের (প্রায় ২৩৮ বিলিয়ন টঝউ) তুলনায়। আয়োজনের সর্বোচ্চ খরচের খাতগুলো ছিল নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত জেট ও হেলিকপ্টার, ৯০টি প্রাইভেট প্লেন, ৩০টি ওয়াটার ট্যাক্সি, পাঁচটি স্তরের রাজকীয় বিবাহের সাজ, ‘ফোম পার্টি’, গ্রেট গ্যাটসবি-থিমযুক্ত অনুষ্ঠান, কাস্টম কর্ডিউরি ডলসেওগ্যব্বানা-গাউনের ২৯-২৭টি পোশাক এবং আয়োজনের ভেন্যু ভেনিসের ঐতিহাসিক স্থান- যেমন : সান জর্জিও মেজিওরে দ্বীপে বিবাহ, মাডোনা ডেল’ওর্টো ক্লোসটারে প্রি-পার্টি, এর্সেনালে থিম নৈশাচর্য ইত্যাদি।
স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশকর্মীরা ভেনিসের জনসংখ্যা ও ওভারট্যুরিজম সমস্যার প্রেক্ষিতে বিয়েটিকে সমালোচনাও করেন, তবে স্থানীয় সরকার এবং ব্যবসায়ীরা এটিকে শহরের অর্থনীতির জন্য ‘মিড ইয়ার বুম’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বেজোস ও স্যানচেজ এই আয়োজনে প্রায় ৩?মিলিয়ন ইউরো দান করেন স্থানীয় গবেষণা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে, যেখানে অন্তর্ভুক্ত ছিল ইউনেস্কো ভেনিস অফিস, কোরিলা এবং ভেনিস ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
সারসংক্ষেপে, বেজোস-স্যানচেজ দম্পতির বিয়ে ভেনিস নগরীকে পুরোপুরি একটি বিলাসবহুল, ইয়াকুজারিÑ ফুলে ফুলে থিম পার্টি হিসেবে রূপান্তরিত করে, যা মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে বিশ্বের সংবাদ শিরোনামে জায়গা করে নেয়Ñ বিশাল ব্যয়, আন্তর্জাতিক অতিথি তালিকা, সামাজিক বিতর্ক, গভীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটÑ সবমিলিয়ে ‘বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল এবং স্মরণীয় বিয়ে’ হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখায়।
সাইদ গুস্তেরিয়েভ ও খাদিজা উঝাকোভার বিয়ে
২০১৬ সালে রাশিয়ার ব্যবসায়ী মিখাইল গুস্তেরিয়েভের ছেলে সাইদ গুস্তেরিয়েভ ও খাদিজা উঝাকোভার বিয়ে বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিয়ের একটি হিসেবে পরিচিত। এই বিয়েতে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জানা যায়। বিয়ের মূল অনুষ্ঠানটি মস্কোর অভিজাত ‘সাফিসা’ রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রায় ৬০০ অতিথি উপস্থিত ছিলেন। এই বিয়েতে রাশিয়ার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং দেশি-বিদেশি নামি ব্যক্তিরা অতিথি হিসেবে যোগ দেন।
নববধূ খাদিজা উঝাকোভা পরেছিলেন বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার এলি সাবের ডিজাইন করা একটি গাউন, যার ওজন ছিল প্রায় ২৫ কেজি এবং যার মূল্য ধরা হয় প্রায় ২৫০ হাজার থেকে ৩৫০ হাজার ডলারের মধ্যে। খাদিজার মাথায় ছিল মূল্যবান হীরার টিয়ারা, যার দাম ছিল প্রায় ৫ মিলিয়ন ইউরো। পুরো ভেন্যু সাজানো হয়েছিল লাখ লাখ ডলারের ফুল দিয়ে এবং অতিথিদের জন্য পরিবহনব্যবস্থা হিসেবে বিলাসবহুল রোলস-রয়েস গাড়ির বহর রাখা হয়েছিল।
য়ের কেকও ছিল ব্যতিক্রম, এটি ছিল একাধিক স্তরের এবং মানুষের সমান উচ্চতার। অনুষ্ঠানে অতিথিদের জন্য পরিবেশিত হয়েছিল বিলাসবহুল ইউরোপীয়, ককেশিয়ান ও জাপানি খাবার। বিয়ের মূল আকর্ষণের মধ্যে ছিল বিশ্বের সেরা তারকাদের পারফরম্যান্স। জেনিফার লোপেজ, স্টিংসসহ বিশ্বখ্যাত শিল্পীরা পারফর্ম করেছিলেন এই বিয়েতে।
আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের আয়োজন বলা হয় খাদিজা-সাইদের বিয়েকে। দেশি-বিদেশি প্রায় ৬০০ অতিথি এ বিয়েতে ছিলেন। আসরে গান গাওয়ার জন্য জেনিফার লোপেজ গান গাইতে ঘণ্টাপ্রতি ১০ লাখ ডলার পারিশ্রমিক নিয়েছেন বলেও শোনা যায়। পরে লন্ডনেও একটি বড় আকারের বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই বিয়ে এতটাই ব্যয়বহুল এবং বিলাসবহুল ছিল যে, এটি আজও বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও ব্যয়বহুল বিয়ের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
ইশা আম্বানি ও আনন্দ পিরামলের বিয়ে
ইশা আম্বানি ও আনন্দ পিরামলের বিয়ে ২০১৮ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত হয় এবং এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল বিয়ে হিসেবে পরিচিত। অনুমান করা হয়, এই রাজকীয় বিয়েতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৭৫০ কোটি রুপি)। বিয়ের আয়োজনে ছিল বিলাসবহুল প্রি-ওয়েডিং পার্টি, যা উদয়পুরের রাজপ্রাসাদে সম্পন্ন হয়, যেখানে অতিথিদের থাকার জন্য পাঁচ তারকা হোটেল সম্পূর্ণ বুক করা হয়েছিল।
বিয়ের অতিথির তালিকায় ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ব্যক্তিরা, যেমন হিলারি ক্লিনটন, বেয়ন্সে, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, শাহরুখ খান, আমির খানসহ বলিউডের প্রায় সব বড় তারকা। বেয়ন্সে নিজে এই বিয়ের অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেছিলেন, যা পুরো আয়োজনকে আরও ঐশ্বর্যময় করে তোলে। অতিথিদের জন্য ছিল ব্যক্তিগত জেট, রাজকীয় আতিথেয়তা, বহুমূল্য উপহার ও ভোজনের সুব্যবস্থা।
রাধিকা মার্চেন্ট ও অনন্ত আম্বানির বিয়ে
রাধিকা মার্চেন্ট ও অনন্ত আম্বানির বিবাহকে বর্তমান সময়ের বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিয়ের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বিয়েতে আনুমানিক খরচ হয়েছে ৬০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫,০০০ থেকে ৮,০০০ কোটি টাকা। বিয়ের মূল আয়োজন শুরু হয় গুজরাটের জামনগর শহরে, যেখানে তিন দিনের প্রি-ওয়েডিং অনুষ্ঠানে অতিথিদের জন্য পরিবেশন করা হয় প্রায় ৩৭,৫০০ ধরনের খাবার এবং সাজানো হয়েছিল দুই কোটি ফুল দিয়ে। অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বিশ্ববিখ্যাত গায়িকা রিহানার পারফরম্যান্স, যিনি প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলারের পারিশ্রমিকে গান করেন।
পরে ইউরোপের বিলাসবহুল ক্রুজে আরও পার্টি অনুষ্ঠিত হয় যেখানে জাস্টিন বিবার, কেটি পেরি, অ্যান্ড্রেয়া বোচেল্লি এবং ব্যাকস্ট্রিট বয়েজের মতো তারকারা উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রিতদের তালিকায় ছিলেন বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, টনি ব্লেয়ার, ইভাঙ্কা ট্রাম্প, কিম কারদাশিয়ান, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, শাহরুখ খান, সালমান খানসহ বিশ্বের নামিদামি ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং সেলিব্রিটিরা। বিয়ের আসল অনুষ্ঠান হয় মুম্বাইয়ের জিও ওয়ার্ল্ড কনভেনশন সেন্টারে, যেখানে শতাধিক প্রাইভেট জেট এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছিল।
বিয়ের আমন্ত্রণপত্র ছিল স্বর্ণ ও রুপার বাক্সে তৈরি, যার মূল্য ছিল প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। বিয়ের সাজসজ্জার জন্য বিশ্বের সেরা ডিজাইনারদের দ্বারা ফুল ও প্রাণীর মূর্তি তৈরি করা হয়, যেখানে প্রতিটি মূর্তির জন্য ব্যবহৃত হয়েছে লক্ষাধিক ফুল। যদিও এই বিয়ে বিশ্বের নজর কাড়ে এবং বিলাসিতার নতুন মাইলফলক স্থাপন করে, তবে খরচের পরিমাণ নিয়ে সমালোচনাও তৈরি হয়। অনেকেই একে ‘অতিরিক্ত প্রদর্শনী’ বলে মন্তব্য করেন, তবে আম্বানি পরিবার জামনগরের ৫১ হাজার দরিদ্র মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করায় কিছুটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে, এই বিয়েটি এটি ছিল এক বিস্ময়কর বিলাসিতার প্রদর্শনী, যা বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
ডায়ানা স্পেনসার ও প্রিন্স চার্লসের বিয়ে
ডায়ানা স্পেনসার ও প্রিন্স চার্লসের বিয়ে ১৯৮১ সালের ২৯ জুলাই পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ব্যয়বহুল এবং রাজকীয় এক অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত। এই বিয়েতে প্রায় ৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (সেই সময়ের হিসেবে) খরচ হয়েছিল, যা বর্তমান মূল্যমান অনুযায়ী প্রায় ১৫৬ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিখ্যাত সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে আয়োজিত এই ঐতিহাসিক বিয়েতে প্রায় ৩,৫০০ অতিথি সরাসরি উপস্থিত ছিলেন এবং বিশ্বব্যাপী টেলিভিশনে প্রায় ৭৫ কোটি মানুষ এই অনুষ্ঠান সরাসরি দেখেছিল। অনুষ্ঠানে বিশ্বের প্রায় সব রাজপরিবারের প্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, সেলিব্রিটি এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। লেডি ডায়ানার আইকনিক ২৫ ফুট লম্বা গাউন ও তার শোভাযাত্রা বিশ্বজুড়ে দারুণ আলোড়ন তুলেছিল। সারা লন্ডন শহর রাজকীয় সাজে সেজে উঠেছিল এবং অনুষ্ঠানকে ঘিরে ছিল কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এই বিয়েকে ‘ফেয়ারি টেল ওয়েডিং’ বলা হয়।
মেগান মার্কেল ও প্রিন্স হ্যারির বিয়ে
মেগান মার্কেল ও প্রিন্স হ্যারির বিয়ে ২০১৮ সালের ১৯ মে ইংল্যান্ডের উইন্ডসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে অনুষ্ঠিত হয় এবং এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল ও বহুল আলোচিত রাজকীয় বিয়ে হিসেবে বিবেচিত। বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, এই বিয়েতে আনুমানিক খরচ হয়েছিল প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৩০০ কোটি টাকা), যার বড় অংশই নিরাপত্তা ব্যবস্থার পেছনে ব্যয় হয়। বিয়ের আয়োজনে ছিল ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় শোভাযাত্রা, বিলাসবহুল আতিথেয়তা, মনোমুগ্ধকর ফুলের সাজসজ্জা এবং ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় পোশাক।
অতিথিদের তালিকায় ছিলেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যরা ছাড়াও অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব, যেমন অপরাহ উইনফ্রে, জর্জ ও আমাল ক্লুনি, সেরেনা উইলিয়ামস, ডেভিড ও ভিক্টোরিয়া বেকহ্যামসহ বহু সেলিব্রিটি। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ টেলিভিশনে এই বিয়ে সরাসরি দেখেছিল, যা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে যায়।