ঢাকায় মশা নিধনে দুই সিটি করপোরেশন নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ওষুধ ছিটানো, সচেতনতামূলক প্রচার, আবার কোথাও কোথাও অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে পরিস্থিতি আরো জটিল। ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বিশেষ করে বরিশাল বিভাগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
শনিবার (২৮ জুন) সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় সারা দেশে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ৩৯২ জন। এদের মধ্যে ঢাকার বাইরের রোগীর সংখ্যা ৩৪৪ জন, যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৮৮ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ অ্যান্ড ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের শনিবার প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু বরিশাল বিভাগেই আক্রান্ত হয়েছেন ১৪১ জন। যা সারা দেশের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৯ হাজার ৪৮৪ জনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৫৮ দশমিক ৯০ শতাংশ পুরুষ এবং ৪১ দশমিক ১০ শতাংশ নারী। মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের, যাদের মধ্যেও পুরুষের সংখ্যাই বেশি।
আইইডিসিআরের জরিপ ও স্বাস্থ্য বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, বরিশাল, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বরগুনার মতো জেলাগুলোতে এডিস মশার ঘনত্ব ও রোগীর সংখ্যা দুই-ই বাড়ছে।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, “বরগুনায় খাবার পানির সংকট থাকায় মানুষ বড় পাত্রে পানি জমিয়ে রাখে, যা অনেক সময় খোলা থাকে বা কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত হয়। সেখানে সহজেই মশা প্রজনন ঘটাতে পারে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, “বৃষ্টির পানি জমে থাকা, প্লাস্টিক প্যাকেট-পাত্রে পানি জমা, মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই ডেঙ্গু বাড়ছে।”
চিকিৎসার অভাবে ঢাকামুখী রোগী
ঢাকার বাইরে চিকিৎসা অবকাঠামো দুর্বল থাকায় প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা ছুটে আসছেন ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে। এতে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছে এবং গুরুতর রোগীর পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে তৈরি হচ্ছে জটিলতা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুস্তাক হোসেন বলেন, “চিকিৎসাব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালকে প্রস্তুত করতে হবে যাতে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগী চিহ্নিত ও চিকিৎসা শুরু করা যায়।”
তথ্যচিত্র: গত ২৪ ঘণ্টার চিত্র
নতুন আক্রান্ত: ৩৯২ জন
মৃত্যু: ২ জন (বরিশাল বিভাগ ও ঢাকা উত্তর সিটি)
সর্বোচ্চ আক্রান্ত বিভাগ: বরিশাল (১৪১ জন)
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন: ২৬০ জন।
মোট আক্রান্ত (২০২৫): ৯,৪৮৪ জন।
মোট মৃত্যু (২০২৫): ৪১ জন।
২০২৪ সালে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন, মৃত্যু হয়েছিল ৫৭৫ জনের। এর আগের বছর ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ হাজার ৭০৫ জন। এবারের মৌসুমেও সেই ভয়াবহতার পূর্বাভাস মিলছে তবে এবার সংকটের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকার বাইরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল সিটি করপোরেশন নয়, দেশের প্রতিটি পৌরসভা, ইউনিয়ন পর্যায়ে মশা নিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে হবে। তরুণদের নিয়ে সচেতনতা কার্যক্রম, ব্যবহৃত পাত্র ব্যবস্থাপনা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা অবকাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। ডেঙ্গু আর রাজধানীকেন্দ্রিক সমস্যা নয়, বরং সঠিক পদক্ষেপ না নিলে দেশজুড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলবে।