ঢাকা
২৫শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রাত ৯:৪০
logo
প্রকাশিত : জুন ২৫, ২০২৫

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনে ‘উপেক্ষিত’ হোমিও-ইউনানি-আয়ুর্বেদ

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। কমিশনে নেওয়া হয়নি এসব খাতের প্রতিনিধি। এমনকি এসব খাত-সংশ্লিষ্টদের মতামতও নেওয়া হয়নি। কিছু বিষয় সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজন করতে সংস্কার কমিশনে ১৮ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

যদিও সংস্কার কমিশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমরা নিজেদের কোনো তথ্য দেইনি। বিবিএসের মাধ্যমে জরিপ করিয়ে তথ্য উপস্থাপন করেছি। আর কোনো খাতের বিরুদ্ধে আমরা নই। আমরা খাতগুলোর নানা সংস্কারের প্রস্তাব করেছি। এর মধ্যে এই খাতগুলোরও গবেষণা করে ফলাফল জেনে সমর্থনের সুপারিশ করেছি।

চিকিৎসার হারে ‘ভুল’
প্রস্তাবিত সংস্কার প্রতিবেদনে (পৃষ্ঠা নম্বর-৫১, ৭৩) জরিপ থেকে প্রাপ্ত মতামত অনুযায়ী, বিগত এক বছরে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাসেবা এবং ১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাসেবা নিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ, বর্তমানে টারশিয়ারি পর্যায়ে ১০০ শয্যা (প্রস্তাবিত ২৫০) বিশিষ্ট একটি সরকারি ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ১০০ শয্যা (প্রস্তাবিত ২৫০) বিশিষ্ট একটি সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে—যেখানে বহির্বিভাগে প্রতিদিন প্রত্যেক হাসপাতালে গড়ে ৩০০-৩৫০ জন রোগী দেখা হয় এবং সারা দেশে প্রায় ৩৫০টি হাসপাতালে (মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে) ইউনানি (বিইউএমএস), আয়ুর্বেদিক (বিএএমএস) ও হোমিওপ্যাথিক (বিএইচএমএস) চিকিৎসকরা সংশ্লিষ্ট পদ্ধতিতে চিকিৎসাসেবা দেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান, বিমসটেকে দেওয়া সরকারি রিপোর্ট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হোমিও, দেশজ, এএমসি শাখা ও সরকারি রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে আগত ২৮ শতাংশ রোগীর হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা চিকিৎসা দেন।

বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ড (বর্তমানে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিল) ও স্থানীয় স্বাস্থ্য জরিপের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ মানুষ নিয়মিত বা মাঝে-মধ্যে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নেন।

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা খাতে স্বাস্থ্যসেবার তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক এ সেক্টরে চিকিৎসা দিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণ করছেন এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। কমিশনের রিপোর্ট তাদের এই ভূমিকাকে খাটো করে দেখিয়ে এই চিকিৎসা খাতগুলোকে আবমাননা করেছেন।-হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. মনির আহম্মদ

বাংলাদেশ বোর্ড অব ইউনানি অ্যান্ড আয়ুর্বেদিক সিস্টেম অব মেডিসিনের মতে, বালাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ রোগী এই ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করেন, বিশেষ করে যেসব জেলায় আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সীমিত।

২০১৫ সালে আশা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিবিসি বাংলার যৌথ গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ নিয়মিতভাবে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নেন।

সর্বোপরি বলা যায়, বাংলাদেশে আনুমানিক ২০-৪০ শতাংশ মানুষ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নেন। আনুমানিক ২০-৩০ শতাংশ মানুষ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নেন এবং ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন নেন।

কমিশনের রিপোর্ট মোতাবেক ৮৪৪ জন স্নাতক ও তিন হাজার ৭৩৩ জন ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ডিপ্লোমা চিকিৎসক রয়েছেন। অথচ বাংলাদেশ হেলথ ওয়ার্কফোর্স স্ট্রাটেজি ২০২৪-এর তথ্যমতে, প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা হোমিওপ্যাথিক স্নাতক চিকিৎসক ১৮৬৫ জন, হোমিওপ্যাথিক ডিপ্লোমা চিকিৎসক ৩৮ হাজার ৫৪ জন, ইউনানি স্নাতক চিকিৎসক ৭৮০ জন, ইউনানি ডিপ্লোমা ও সার্টিফায়েড প্র্যাকটিশনার ৭ হাজার ৫৯৫ জন এবং আয়ুর্বেদিক স্নাতক চিকিৎসক ৬৪৮ জন, আয়ুর্বেদিক ডিপ্লোমা ও সার্টিফায়েড প্র্যাকটিশনার ৪ হাজার ৮২৮ জন।

আন্তর্জাতিক চুক্তি
হোমিওপ্যাথিক, আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) স্বীকৃত ও ব্যবহৃত। ডাব্লিউএইচও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতে ট্র্যাডিশনাল ও পরিপূরক মেডিসিন ব্যবহার করার জন্য জোর সুপারিশ করেছে। এমনকি প্রতি দশ বছর অন্তর অন্তর ‘গ্লোবাল ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন স্ট্রাটেজি’ প্রণয়ন করে। বাংলাদেশও এই স্ট্রাটেজির অন্তর্ভুক্ত চুক্তিবদ্ধ দেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিশ্চিত করতে গ্লোবাল ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন সেন্টার গঠন করেছে। অথচ সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে এর কোনো কিছুই উল্লেখ না করে বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে এই সেক্টরগুলোকে সংকোচনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

‘ডা.’ লেখা নিয়ে বিতর্ক উসকে দেওয়া হয়েছে
কমিশনের প্রতিবেদনে পৃষ্ঠা নম্বর ১১৫, ১২৪, ১৩৪-এ বলা হয়েছে ‘এমবিবিএস ও বিডিএস ব্যতীত কেউ চিকিৎসক পরিচয়ে চিকিৎসা দিতে পারবেন না।’ তাহলে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা কীভাবে চিকিৎসাসেবা দেবেন? এই প্রস্তাব বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা আইন-২০২৩ এবং ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক প্র্যাকটিশনার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩-এর পরিপন্থি।

বিষয়গুলো আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ইতোমধ্যে লিখিত প্রস্তাবনার পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলনও করেছি। আশা করি, তারা যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। অন্যথায় আমরা এই সেক্টরের সবাইকে নিয়ে আন্দোলনে নামবো।- বুয়ামা সভাপতি ডা. তাওহীদ আল বেরুনী

কমিশনের প্রতিবেদনের ১৭০ পৃষ্ঠায় (১৯(১)) বলা হয়েছে, বিএমডিসি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন (ব্যবস্থাপত্র) ছাড়া কোনো ওষুধ বিতরণ করা যাবে না। এ প্রস্তাবটি অসঙ্গতিপূর্ণ। এই প্রস্তাব বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা আইন-২০২৩ এবং ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক প্র্যাকটিশনার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩-এর পরিপন্থি। কারণ, বিএমডিসি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের মাধ্যমে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ ব্যবস্থাপত্র হয়। কিন্তু হোমিওপ্যাথিক কাউন্সিল, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কাউন্সিলের রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনের ওষুধ কীভাবে বিতরণ করা হবে?

বর্তমানে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ এবং জেলা সদর হাসপাতাল ও থানা হেলথ কমপ্লেক্সগুলোতে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে, তা বন্ধ হলে ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্যসেবা বাধাগ্রস্ত হবে। যে কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থায় তার ওষুধ প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে রোগীকে দেওয়া হয়। এটি রোগীর একটি অধিকার।

ক্রয়সীমার বাইরে যাবে ওষুধ, নির্ভরতা বাড়বে বিকল্পে
বাংলাদেশ যদি ২০২৬ সাল থেকে এলডিসি থেকে বের হয়, তবে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের মূল্য কয়েক গুণ বেড়ে যাবে, এতে সাধারণ মানুষের জন্য ওষুধ ক্রয়সীমার বাইরে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। কিন্তু কমিশন এই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপেক্ষা করে গেছে।

কমিশনের রিপোর্টে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস (বিএইএস), বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশনে, হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিভাগকে উপস্থাপন করা হয়নি এবং কোনো প্রতিনিধি প্রস্তাব করা হয়নি। যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই চিকিৎসা গ্রহণ করেন, তাই প্রস্তাবিত বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস এবং বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশনে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক সেক্টরের একটি আলাদা বিভাগ এবং একজন করে প্রতিনিধি প্রস্তাব করা উচিত ছিল।

কমিশনের প্রতিবেদনে (পৃষ্ঠা নম্বর ২৩, ১১৪) নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্থলে বিএমডিসিসহ বিভিন্ন কাউন্সিলের উল্লেখ থাকলেও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিল ও প্রক্রিয়াধীন ইউনানি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিলের উল্লেখ নেই।

শিক্ষার মানোন্নয়ন ও বাজার সম্প্রসারণে সুপারিশ নেই
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক এবং অন্য প্রাকৃতিক ওষুধের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। বিভিন্ন বাজার গবেষণা অনুসারে, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের বাজার ৯ বিলিয়ন ডলার (২০২০) থেকে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। বর্তমানে বিশ্বে আয়ুর্বেদিক ওষুধের বাজার আট বিলিয়ন ডলার (২০২২) থেকে আগামী ২০৩২ সাল নাগাদ প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। পাশাপাশি ইউনানি ওষুধেরও সারা বিশ্বে ব্যাপক বাণিজ্যিক বাজার গড়ে উঠছে।

আমাদের টিমে তাদের প্রতিনিধি নেই, ঠিক। তাদের কাউন্সিল বা সংগঠনকে ডাকা হয়েছে কি না, আমার ঠিক মনে নেই। তবে আমরা সবার কথা নিয়েছি। আমরা তো তাদের বিষয়ে বড় কোনো প্রস্তাবও করিনি। বড় কোনো ভুল হওয়ারও তো সুযোগ নেই।- স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন

১৯৯৮ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০৫০ সালের মধ্যে ওষুধি গাছ এবং সংশ্লিষ্ট পণ্যের বিশ্ব বাণিজ্য পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা ওষুধি গাছের বিপুল রপ্তানি সুযোগের ইঙ্গিত দেয়।

২০০৩ সালে এসইডিএফ এবং ইন্টারকো অপারেশনের এক গবেষণায় বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত ভেষজ ওষুধের বাজারের প্রায় ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমান করা হয়েছিল, যার মধ্যে আয়ুর্বেদিক খাতের বাজার প্রায় ১০০ কোটি টাকা, ইউনানি খাতের বাজার ১৮০ কোটি টাকা এবং হোমিওপ্যাথির বাজার ৫০ কোটি টাকা (বিবিপিসি)। বাংলাদেশে ভেষজ ওষুধের বাজার বার্ষিক প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ৩২৩টি অ্যালোপ্যাথিক, ২৮৬টি ইউনানি, ২০৬টি আয়ুর্বেদিক এবং ৭১টি হোমিওপ্যাথিক ও ৩৯টি হার্বাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

কমিশনের প্রতিবেদনে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা সংক্রান্ত একমাত্র প্রস্তাবনায় (পৃষ্ঠা নম্বর ৮২-তে) বলা হয়েছে, ‘জাতীয় পর্যায়ে গবেষণার ভিত্তিতে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রভাব ও ফলাফল মূল্যায়ন, প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন কাঠামো গঠন করতে হবে।’ এ প্রস্তাবনা অনুযায়ী হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার প্রভাব ও ফলাফল মূল্যায়ন এবং পর্যালোচনার কথা বলা হয়েছে। মূলত প্রস্তাবনাটি বাংলাদেশে এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে সংকুচিত করার উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের কাছে ১৮ দফা প্রস্তাবনার সার সংক্ষেপ
তিন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের কাছে ১৮ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

১। আইন ও কাউন্সিল গঠন: ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষা আইনের অর্ডিন্যান্স জারি করে মেডিকেল কাউন্সিল গঠন ও বাস্তবায়ন, হোমিওপ্যাথি আইন ২০২৩-এর অধীনে বিধিমালা প্রণয়ন।

২। চিকিৎসক পদে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তি: নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৫০ জন চিকিৎসক ও কর্মকর্তাকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করে চিকিৎসা কার্যক্রম টিকিয়ে রাখা।

৩। জেলা-উপজেলায় ইউনিট স্থাপন: জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা হাসপাতাল বা বিদ্যমান সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিকল্প চিকিৎসা ইউনিট স্থাপন ও চিকিৎসক নিয়োগ।

৪। প্রশাসনিক কাঠামো: বিকল্প চিকিৎসার জন্য মন্ত্রণালয়ে আলাদা বিভাগ/মন্ত্রণালয় ও জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন, বিশেষজ্ঞ নিয়োগ।

৫। স্বাস্থ্য কমিশনে প্রতিনিধি: হোমিওপ্যাথি ও দেশজ চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য কমিশন ও হেলথ সার্ভিস কাঠামোয় আলাদা বিভাগ ও অধিদপ্তর গঠন।

৬। উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণ: বিকল্প চিকিৎসায় এমডি/এমফিল/পিএইচডি চালু, সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে পোস্টগ্র্যাজুয়েট কোর্স শুরু।

৭। বিসিএস নিয়োগ: বিএইচএমএস, বিইউএমএস, বিএএমএস চিকিৎসকদের জন্য আলাদা বিসিএস ক্যাডার গঠন।

৮। ওষুধ নিয়ন্ত্রণ: বিকল্প ওষুধ নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আলাদা বিভাগ ও জনবল নিয়োগ।

৯। কমিউনিটি পর্যায়ে নিয়োগ: ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসকদের পদ সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ ও আউটডোর সুবিধা প্রদান।

১০। গবেষণা প্রতিষ্ঠান: বিকল্প চিকিৎসায় গবেষণা কাউন্সিল ও ইনস্টিটিউট গঠন, গবেষণা ফান্ড ও জার্নাল চালু।

১১। পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রশিক্ষণ: রেডিওলজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ইত্যাদিতে বিকল্প চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও নীতিমালা।

১২। ভেষজ উদ্যান: ঔষধি গাছ সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য জাতীয় ভেষজ উদ্যান প্রতিষ্ঠা।

১৩। ওষুধ সরবরাহ: সরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে বিকল্প ওষুধ সরবরাহের জন্য আলাদা বিভাগ চালু, ফার্মাকোভিজিল্যান্স কার্যক্রম শুরু।

১৪। নীতিমালায় অন্তর্ভুক্তি: স্বাস্থ্যনীতির সব স্তরে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত।

১৫। বেসরকারি হাসপাতাল: বেসরকারিভাবে বিকল্প চিকিৎসা হাসপাতাল স্থাপন ও লাইসেন্সিং ব্যবস্থা চালু।

১৬। আন্তর্জাতিক সমন্বয়: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ভারতের আয়ুশসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় ও চুক্তি বাস্তবায়ন।

১৭। প্রোমোশনাল কাউন্সিল: চিকিৎসাসেবার সম্প্রসারণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে অবস্থান তৈরিতে প্রোমোশনাল কাউন্সিল গঠন।

১৮। জাতীয় কৌশল বাস্তবায়ন: ২০১৫ সালের ‘ন্যাশনাল স্ট্রাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান অন এএমসি’ অনুমোদন ও জাতীয় নীতি প্রণয়ন।

কমিশনের প্রস্তাবনা দেওয়া ব্যক্তিদের একজন হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. মনির আহম্মদ। তিনি বলেন, ‘আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা খাতে স্বাস্থ্যসেবার তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক এ সেক্টরে চিকিৎসা দিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণ করছেন এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। কমিশনের রিপোর্ট তাদের এই ভূমিকাকে খাটো করে দেখিয়ে এই চিকিৎসা খাতগুলোকে আবমাননা করেছেন।’

বায়োফার্মার ন্যাচারাল মেডিসিন বিভাগের ম্যানেজার ডা. মো. মোহসিন আলী বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবায় ইউনানি সেক্টরের ভূমিকাকে তুচ্ছ করে দেখানো হয়েছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুল উপস্থাপন করা হয়েছে। তথ্য গোপন করে এই চিকিৎসা খাতগুলোকে অবমূল্যায়ন, চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবা সম্প্রসারণে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।’

ন্যাশনাল হোমিওপ্যাথিক ডক্টরস ফোরামের মহাসচিব ডা. টিপু সুলতান বলেন, ‘সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ একটি, বেসরকারি ৬৬টি। এখানে ব্যাচেলর কোর্সে (৫ বছর অ্যাকাডেমিক, এক বছর ইন্টার্ন) এমবিবিএসের সমমানের পড়াশোনা হয়। শুধু মেডিসন আলাদা, বাকি সব সাবজেক্ট অ্যালোথিক ডাক্তারদের মতোই শিখতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি কলেজে আউটডোর ও পুরো বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা হাসপাতালে ১৪৫ জনের চিকিৎসকসেবা দেয়। আমরা বিশাল জনগোষ্ঠীকে (জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ) সেবা দেই। এগুলো ইগনোর করে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, যেখানে আমাদের প্রতিনিধি নেই। অথচ পিছিয়ে পড়া এই খাতকে এগিয়ে নিতে গেলে আমাদের মতামত প্রয়োজন ছিল। এটি এসডিজি ও এমডিজি পূরণে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে দেবে। স্বাস্থ্য সংস্কার খাতের প্রতিবেদন সংস্কার করা প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ ইউনানি অ্যান্ড আয়ুর্বেদিক মেডিসিন অ্যাসোসিয়েশন (বুয়ামা) সভাপতি ডা. তাওহীদ আল বেরুনী বলেন, ‘বিষয়গুলো আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ইতোমধ্যে লিখিত প্রস্তাবনার পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলনও করেছি। আশা করি, তারা যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। অন্যথায় আমরা এই সেক্টরের সবাইকে নিয়ে আন্দোলনে নামবো।’

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘তথ্যগুলো আমাদের বানানো তথ্য নয়। এগুলো বিবিএসকে দিয়ে জরিপ করিয়েছি। আমরা প্রশ্ন দিয়ে দিয়েছি, তারা জরিপ করে আমাদের দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের টিমে তাদের প্রতিনিধি নেই, ঠিক। তাদের কাউন্সিল বা সংগঠনকে ডাকা হয়েছে কি না, আমার ঠিক মনে নেই। তবে আমরা সবার কথা নিয়েছি। তারা আমাদের কাছে এসেছে, হয়তো একটা গ্রুপের হয়ে। আমরা তো তাদের বিষয়ে বড় কোনো প্রস্তাবও করিনি। বড় কোনো ভুল হওয়ারও তো সুযোগ নেই। তাদের সেবাগুলো কতখানি ফলপ্রসূ হচ্ছে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী- এগুলো আমাদের জানতে হবে। এগুলো জরিপ করে তাদের সমর্থন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর বেশি কিছু তো বলা হয়নি।’

logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram