শেখ দীন মাহমুদ, পাইকগাছা, (খুলনা) প্রতিনিধি: নানা সংকটের মাঝেও সুন্দরবন উপকূলীয় খুলনার পাইকগাছায় প্রত বছর বাড়ছে তরমুজের আবাদ। আবহাওয়ার উপযোগী পরিবেশ, উৎপাদনের পাশাপাশি চাহিদা ও বেশি লাভজনক হওয়ায় জনপদে প্রতিবছর তরমুজের আবাদ বাড়ছে। কৃষকের পাশাপাশি শিক্ষিত বেকাররাও ঝুঁকে পড়ছেন তরমুজের আবাদে। তবে কৃষির এ নতুন সম্ভাবনায় নিত্য নতুন উদ্যোক্তার জন্ম হলেও বাধ সাধছে পানির সুষ্ঠু সরবরাহ, বিদ্যুৎ ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। তরমুজ চাষের সাথে সম্পৃক্তরা সরকারের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য মতে, জনপদের উৎপাদিত কোটি কোটি টাকার তরমুজ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় সরবরাহ করা হয়। অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানকার উৎপাদিত তরমুজের গুণগত মান ব্যতিক্রম হওয়ায় দেশময় এর চাহিদাও বেশি। সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এক সময়ের সাদা সোনার রাজ্য পাইকগাছার কৃষি তরমুজের উপর ভর করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে হাতছানি দিচ্ছে অমিত সম্ভাবনার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি মৌসুমে পাইকগাছা উপজেলায় ২ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। যা বিগত বছরের চেয়ে ৭'শ হেক্টর বেশি। নানা অনুকুল পরিবেশে প্রতিবছর তরমুজ চাষের সাথে যুক্ত হচ্ছে এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবকরা। দীর্ঘ দিন ধরে ফেলে রাখা পতিত জমিতে তরমুজ চাষ করে অর্থনৈতিক ভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন শিক্ষিত বেকার যুবারাও।
উপজেলার একজন সফল তরমুজ এসকল সফল তরমুজ চাষি শান্ত কুমার মন্ডল। তিনি ২৫ বিঘা জমিতে তরমুজের আবাদ করেছেন। ফলনও হয়েছে বাম্পার। তবে তরমুজের ক্ষেতে প্রধান উপাদান মিষ্টি পানির যোগান পেতে এলাকার খাল খনন, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা গেলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি এর মানোন্নয়ন ও চাহিদা বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ। যা এলাকার সামগ্রীক অর্থনীতিতে নতুন পালক গজাবে।
এর আগে দীর্ঘ দিন ধরে এলাকার অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছিল সাদা সোনা খ্যাত বাগদা চিংড়ি। তবে রোগ-বালাইয়ের প্রকোপ, জমির হারি বা ইজারা মূল্য বৃদ্ধিসহ নানা সংকটে চিংড়ি শিল্প এখন খানিকটা হলেও ধুঁকছে।
বিকল্প হিসেবে কয়েক বছর আগে থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শুরু হওয়া রবি ফসল তরমুজ চাষে সাফল্য ইতোমধ্যে নিজেকে অর্থকরী ফসলের তালিকায় যুক্ত করেছে। সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এ এলাকায় বর্তমানে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে তরমুজ। আবাদ শুরুর মাত্র ৩ মাসে বাজারজাত করা যায়। উৎপাদন খরচ, ফলন ও চাহিদা ভাল থাকায় প্রতি বছর এর আবাদ বেড়েই চলেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ একরামুল হোসেন বলেন, গত বছর এ উপজেলায় ১ হাজার ৪৪৫ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছিল। আর এবছর আবাদ হয়েছে, ২ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের চেয়ে যা ৭'শ হেক্টর বেশি। উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার মধ্যে মধ্যে মাত্র দু’টি ইউনিয়নে তরমুজের আবাদ হচ্ছে। যার মধ্যে ১ হাজার ৯০ হেক্টর দেলুটি ইউনিয়ন এবং ১ হাজার ৫০ হেক্টর গড়ইখালীতে।
এদিকে কৃষির তরুণ উদ্যোক্তা গড়ইখালীর তরমুজ চাষী শান্ত কুমার মন্ডল ২৫ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করে সবার নজরে এসেছেন। তিনি উপজেলার গড়ইখালী ইউনিয়নের কুমখালী গ্রামের অমল কৃষ্ণ মন্ডলের ছেলে। বিএ পাশ করে চাকুরীর পেছনে না ছুটে তিনি ২০২১ সালে প্রথম বার ৫ বিঘা জমিতে প্রথম তরমুজ চাষ করেছিলেন। এর ৩ বছর পর এবার এলাকার পতিত এবং ফেলে রাখা ২৫ বিঘা জমিতে হাইব্রিড এফ-১ জাতের তরমুজ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। এখন তার ক্ষেতের তরমুজের বয়স মাত্র ৬০ দিন। সবুজ প্রান্তর জুড়ে সবুজ তরমুজের সমারোহ। কৃত্রিম পরাগায়ন করার ফলে অন্যান্যদের তুলনায় তার ক্ষেতে প্রচুর ফল ধরেছে যা, এবং বাড়ছেও দ্রুত গতিতে। ফলের আকৃতিও অনেক সুন্দর। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিটি ফলের ওজন ৮ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত হবে এবং তখন থেকে বাজারজাত করা যাবে বলেও আশা করছেন তিনি। প্রতিদিন তার ক্ষেতে ৫ জন শ্রমিক কাজ করছেন। তরুণ এ কৃষি উদ্যোক্তার তালিকায় শ্রমিকদের মধ্যে ডিগ্রি পাশ দীপক বর্মন ও নমিতা মন্ডলও রয়েছেন। তাদের মতো রবি মৌসুমে তরমুজের ক্ষেতে কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করছেন এলাকার শত শত নারী পুরুষ।
শান্ত জানান, তার প্রতি বিঘা তরমুজ আবাদে খরচ হয়েছে, ২৫ হাজার টাকা। যা বিঘা প্রতি কমপক্ষে ১ লাখ টাকা বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তরমুজ চাষি শান্ত। সফল তরমুজ চাষি শান্ত কুমার মন্ডল বলেন তরমুজ চাষের বিপুল সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, সমস্যা এবং প্রতিবন্ধকতা ও অনেক বেশি।
তিনি বলেন, আমি ২৫ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছি কিন্তু সেচের কোন ব্যবস্থা নাই। কৃষি সমৃদ্ধ এ ইউনিয়নে এ পর্যন্ত কোনো খাল খনন করা হয়নি। ক্ষেতের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোন বিদ্যুৎ লাইন নাই। নেই কোন পুকুর জলাশয়। ফলে বাধ্য হয়ে জেনারেটর দিয়ে পানির ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এ কারণে উৎপাদন খরচ অনেকটাই বেশি হয়েছে। এছাড়া অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কৃষি উপকরণ এবং উৎপাদিত তরমুজ পরিবহনে অনেক ভোগান্তি হয় পাশাপাশি বাজারজাত করার সময় সঠিক দাম পাওয়া যায় না। এতে লাভ অনেক কমে যায় এবং তরমুজ চাষে আগ্রহ হারানোর আশংকা তৈরি হচ্ছে।
তার মতে বিলের খাল খনন করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ, বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে তরমুজ চাষ অনেক বেশি লাভজনক ও আবাদ সম্প্রসারিত হবে বলেও আশাবাদ ব্যাক্ত করেন তিনি।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ একরামুল হোসেন বলেন, তরমুজ স্বল্পমেয়াদি একটি লাভজনক ফসল। রবি মৌসুমে বিলের পতিত এবং ফেলে রাখা জমিতে তরমুজ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন এলাকার কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে উন্নত বীজ সরবরাহ সহ কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে কৃষি বিভাগের এ কর্মকর্তা জানান। খাল খনন সহ তরমুজ চাষ সহজ করতে কৃষি বিভাগ কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন জানান, তরমুজ সহ সকল কৃষি ও কৃষকের সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে উপজেলা প্রশাসন বদ্ধপরিকর। সকল প্রকার সংকট উত্তরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।