এম আনোয়ার হোসেন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি: এবার ঈদে লম্বা ছুটিতে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভ্রমণ পিপাসুরা। ঈদের দিন দুপুর থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ডজনখানেক পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে। অনেকেই পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীদের নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন এসব স্পটে। ছোট-বড় সব বয়সীরা ছবি তুলে, গান গেয়ে আনন্দ করে ঈদের ছুটি উপভোগ করছেন।
জানা গেছে, এবার ৯ দিনের টানা ছুটিতে উপজেলার ১২টি পর্যটন স্পট ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। কক্সবাজার বা সিলেটের মতো না হলেও মিরসরাইয়ের সবুজ পরিবেশ, নির্মল হ্রদ, মনোরম ঝর্না, সমুদ্র সৈকত প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের বিনোদন দিচ্ছে উজাড় করে। দর্শনার্থীরা দিন দিন এই উপজেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।
উপজেলার ১২টি পর্যটন স্পটের মধ্যে রয়েছে মুহুরী প্রজেক্ট, ডোমখালী সমুদ্র সৈকত, জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সমুদ্র সৈকত, সকল বয়সী ভ্রমণ পিপাসুদের বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণ আরশিনগর ফিউচার পার্ক, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম লেক মহামায়া ইকোপার্ক ও লেক, আট স্তর বিশিষ্ট জলপ্রপ্রাত খৈয়াছড়া ঝর্না, রূপসী ঝর্না, বাওয়াছড়া প্রকল্প, বোয়ালিয়া ঝর্না, জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশের উপকূলীয় বন, হিলসডেল মাল্টি ফার্ম এন্ড মধুরিমা রিসোট, নয়দুয়ারিয়া ঝর্ণা। প্র্রতি বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি দর্শনার্থীর ভিড়ে মুখরিত স্পটগুলো।
আরশিনগর ফিউচার পার্কে গিয়ে দেখা গেছে, পর্যটকদের প্রচণ্ড ভিড়। এ যেন অন্যরকম আরশিনগর। পার্কের বিভিন্ন স্পটে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছেন, গল্প করছেন। বিভিন্ন ব্যাচের সহপাঠীদের নিয়ে চলছে ঈদ উৎসব ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। বিশেষ করে বেশি আনন্দ করতে দেখা গেছে পরিবারের সঙ্গে আসা শিশুদের। শিশুরা বিভিন্ন রাইডসে চড়তে দেখা গেছে।
পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০০ টাকায় টিকেট কিনে অনেক কিছু দেখার সুযোগ রয়েছে এখানে। পরিপূর্ণ ঈদ উৎসব উপভোগের সুযোগ রয়েছে এখানে।
আরশিনগর ফিউচার পার্কের পরিচালক জামাল উদ্দিন জানান, নতুন ব্যবস্থাপনায় পর্যটকদের মন জয় করেছে আরশিনগর ফিউচার পার্ক। সব বয়সী পর্যটকদের বিনোদনের কথা মাথায় রেখে আমরা সাজিয়েছি পার্কের বিভিন্ন রাইডসগুলো। এবার প্রতি বছর থেকে বেশি দর্শনার্থী এসেছে। প্রচুর পর্যটক সমাগম হচ্ছে প্রতিদিন। আমরা পর্যটকদের সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করেছি। সুস্থ বিনোদনের জন্য পর্যটকরা স্বপরিবারে এখানে আসেন।
মারুফ মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আয়াত বিন মাঈন বলেন, ‘আমার বাবার সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছি। কয়েকটি রাইডসে চড়েছি, আমার অনেক ভালো লেগেছে।’
চোখে পড়ার মতো পর্যটক দেখা গেছে মহামায়া ইকোপার্কে। পর্যটকদের আনাগোনায় অনেকটা আগের চিরচেনা রূপ বদলে এবার নতুন মাত্রায় ফিরেছে এই পর্যটন স্পটটি।
চট্টগ্রাম শহর থেকে ঘুরতে আসা ৮ বন্ধুর একজন সাদমান ইসলাম বলেন, ‘মহামায়া আমাদের খুব পছন্দের জায়গা। আমরা বছরে কয়েকবার এখানে বেড়াতে আসি। এবার ঈদেও সব বন্ধু মিলে চলে এসেছি। লেকের স্বচ্ছ পানিতে গোসল করেছি। খুব ভালো লাগছে।’
পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা ইকবাল হোসেন মাহিন বলেন, ‘সারা বছর ব্যস্ত থাকি। ঈদে এবার কয়েকদিন ছুটি পেয়েছি। তাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখানে ঘুরতে এলাম। আগেও কয়েকবার এসেছি। খুব ভালো লাগছে। বাচ্চারাও ভালো সময় কাটাচ্ছে।’
ঠাকুরদিঘী-মহামায়া রুটে সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক নুরুল আবছার বলেন, ‘পুরো রমজান মাসে তেমন পর্যটক ছিল না। ঈদের দিন থেকে লোকজন আসতে শুরু করেছেন। আমাদেরও অনেক আয় হচ্ছে।’
মহামায়া ইকোপার্কের ইজারাদার মোহাম্মদ শরিফ উদ্দিন বলেন, মহামায়া খুবই সুন্দর একটি পর্যটন কেন্দ্র। এখানে একই স্থানে রয়েছে লেক, পাহাড়, ঝর্ণা ও রাবার ড্যাম। পাহাড়ের কোলে লেকটির আঁকাবাঁকা অবয়ব অপরূপ সুন্দর। ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত এই লেক। লেকের অন্যতম আকর্ষণ পাহাড়ি ঝর্ণা ও স্বচ্ছ পানি। মহামায়া লেকের নীল জলরাশিতে কায়াকিং করতে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসেন অনেকে।
মিরসরাই উপজেলার ধুম থেকে মহামায়া ঘুরতে আসা নবদম্পতি বলেন, ‘এবার প্রথম এসেছি, খুব ভালো লাগছে এখানে যে কেউ বারবার আসতে চাইবে। এরপর যাব আরশিনগর ফিউচার পার্কে।’
ডোমখালী সমুদ্র সৈকতে মানুষের স্রোত দেখা যায়। অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা এক প্রাকৃতিক সৈকত ডোমখালী বিচ। ঝাউবন, লাল কাকড়ার চর, উত্তাল সাগরে নৌকা ভেসে বেড়ানো, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, হরিণের পদচিহ্ন সবই দেখতে ছুটে যাচ্ছেন সব বয়সী পর্যটক। শুধু দিনে নয়, রাতেও সাগর পাড়ে দেখা মেলে অসংখ্য মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারের। রাতে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রের গর্জন কান পেতে শুনতে সেখানে ছুটে যান তরুণরা।
উপজেলার আরেক কৃত্রিম লেক বাওয়াছড়ায় যাচ্ছেন কেউ কেউ। বাওয়াছড়া লেক স্থানীয়ভাবে নীলাম্বর লেক নামেও পরিচিত। ঈদের ছুটিতে এখানে দুই পাশের সুউচ্চ পাহাড় থেকে পানি লেকে গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য ও শব্দ পর্যটকদের সব ক্লান্তি মুহুর্তেই দূর করে দেবে। এখানে যুবকদের পদচারণা বেশি। দুর্গম পাহাড়ের উঁচু নিচু পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্তি আসে যে কারও। সে কারণে বয়স্কদের এখানে কম দেখা মেলে।
উপজেলার পাহাড়ি ঝর্নাগুলো রাস্তার মুখে মহাসড়কের সংযোগ সড়কে দাঁড়ানো গাড়ির লাইন দেখে বুঝা যাচ্ছে কী পরিমাণ ভ্রমণ পিপাসু লোকজন ঝর্নায় ছুটে আসছেন। যদিও বর্ষা মৌসুমের মতো ঝর্নায় পানি এখন নেই। তবুও পর্যটকরা দূর-দূরান্ত থেকে এসে সব স্পটে না গেলে আনন্দ অপূর্ণ থেকে যায়। তাদের কাছে ঝর্নায় আনন্দই আলাদা।
মিরসরাই প্রতিটি পর্যটন স্পটে এখন প্রচুর পর্যটক। প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে, একই রকম ভিড়। কোন স্পটে যে পর্যটক কমছে না। কয়েকটি স্পটে শুধু ইজারার কারণে টিকিট সংগ্রহ করে যেতে হয়। তবে বেশির ভাগ স্পট উন্মুক্ত।
কুমিল্লা থেকে ঘুরতে আসা মিনহাজ উদ্দিন বলেন, ‘মিরসরাইয়ের সব ঝর্না মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে। শুধু বোয়ালিয়া ঝর্না ঘুরতে পারিনি। এবার ঈদের ছুটিতে এখানে ঘুরতে এলাম। খুব ভালো লাগছে, আমরা একটি বাস ভাড়া করে এসেছি। আমাদের গ্রুপে প্রায় ২৮ জন রয়েছে।’
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহফুজা জেরিন বলেন, ঈদের ছুটি থাকায় এবার পর্যটক বেড়েছে। অন্যান্য বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে সারা বছর পর্যটক থাকেন। ঝর্নায় বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে আসা-যাওয়া করতে বলা হয়েছে। গাইড ছাড়া কেউ যেন ঝর্না যেতে না পারেন, সে বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া আছে।