বাংলাদেশে জাতীয় সংলাপ, শান্তি, আস্থা ও নিরাময়কে উৎসাহিত করতে সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত রয়েছে জাতিসংঘ। গতকাল শনিবার ঢাকায় একটি হোটেলে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘দেশ যখন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এবং পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই যে জাতিসংঘ শান্তি, জাতীয় সংলাপ, আস্থা ও নিরাময়কে উৎসাহিত ও সহায়তা করতে প্রস্তুত।’
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনও বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের ৫০তম বার্ষিকীর সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের রমজান সংহতি সফর বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ—উভয়ের জন্যই একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
কারণ মহাসচিব নিজেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সর্বোচ্চ ত্যাগের পর একটি নতুন বাংলাদেশের গঠনমূলক পর্যায় প্রত্যক্ষ করছেন। ওই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি ন্যায়সংগত, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন। জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর সরকার এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে অর্থবহ বলেও তিনি জানান।
প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, মায়ানমারে ব্যাপক সংঘাত চলছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আরো বলেন, লড়াই থামাতে মায়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মায়ানমারের সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রকেই ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আরাকান আর্মি একটি শক্তি। আমি বিশ্বাস করি, তাদের সঙ্গে অবশ্যই প্রয়োজনীয় আলোচনা হবে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টাও বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় মায়ানমারে একাধিক কর্তৃপক্ষ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সবাইকেই রাজি করাতে হবে।
উপদেষ্টা বলেন, মায়ানমারের সঙ্গে মানবিক করিডর চালুর বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা হয়নি। মানবিক করিডর অপারেশনাল বিষয়। বাংলাদেশ এ বিষয়ে ঢাকায় জাতিসংঘ কার্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর বক্তব্যে উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানান। তিনি পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে বাংলাদেশ এবং বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘রমজান হলো আধ্যাত্মিক পুনর্নবীকরণ ও ঐক্য দেখানোর সময়। প্রতিবছর আমি একটি সংহতি সফর করি এবং কঠিন পরিস্থিতিতে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সময় কাটাই। তাদের সঙ্গে রোজা রাখি এবং তাদের দুর্দশার ওপর বিশ্বব্যাপী আলোকপাত করতে সাহায্য করি।’
গুতেরেস বলেন, ‘এ বছর আমি রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং তাদের আতিথ্যকারী বাংলাদেশি জনগণের সঙ্গে আমার সংহতি প্রকাশ করতে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনাদের সঙ্গে রোজা রাখা এবং ইফতার করা আপনার ধর্ম এবং আপনার সংস্কৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধার প্রমাণ।’
গত শুক্রবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির সফরকে ‘অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী’ বলে উল্লেখ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘করুণা, সহানুভূতি ও উদারতা—রমজান আমাদের মানবতাকে সংযুক্ত করে এমন সর্বজনীন মূল্যবোধের কথা মনে করিয়ে দেয়। শান্তি, উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তার প্রতি অঙ্গীকারের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই মূল্যবোধগুলোর একটি জীবন্ত প্রতীক।’
জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা কার্যক্রম বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় অবদানকারীদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করে। তাদের ত্যাগ ও নিষ্ঠার প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাতে চাই।’
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘আপনাদের জাতীয় যাত্রার এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বাংলাদেশে থাকতে পেরে আমি বিশেষভাবে আনন্দিত। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ যখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন আমি বৃহত্তর গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সমৃদ্ধির ভবিষ্যতের জন্য জনগণের আশাকে স্বীকৃতি দিচ্ছি।’
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। একটি ন্যায়সংগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের লক্ষ্যে আপনাদের (বাংলাদেশিদের) প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তার ভূমিকা পালন করতে হবে।’
আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা জাতিসংঘকে আপনাদের অবিচল অংশীদার হিসেবে বিশ্বাস করতে পারেন। সবার জন্য একটি টেকসই এবং ন্যায়সংগত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে জাতিসংঘ কাজ করবে।’
রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের অসাধারণ উদারতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘এটি (রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের অসাধারণ উদারতা) আপনাদের স্থায়ী মানবিক চেতনার প্রমাণ। বছরের পর বছর ধরে এই জাতির মানুষ, বিশেষ করে, কক্সবাজারের সম্প্রদায়গুলো সহিংসতা ও নিপীড়নের হাত থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখেরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে আসছে।’
মহাসচিব বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ সংহতি এবং মানবিক মর্যাদা প্রদর্শন করেছে এবং প্রায়ই তা উল্লেখযোগ্যভাবে সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক মূল্য দিয়ে করেছে। এই উদারতাকে বিশ্বের হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।’
আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো বেশি দায়িত্ব নেওয়ার এবং শরণার্থী ও তাদের আশ্রয়দাতা সম্প্রদায় উভয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তা প্রদানের জন্য অনুরোধ জানাতে থাকব।’
গত শুক্রবার কক্সবাজারে দেওয়া বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘কক্সবাজারে যেমনটি আমি বলেছিলাম, আমরা একটি গভীর মানবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে। আর্থিক সহায়তা কাটছাঁটের ফলে ২০২৪ সালে মানবিক সহায়তার তুলনায় এ বছর মাত্র ৪০ শতাংশ সহায়তা পাওয়ার নাটকীয় ঝুঁকির মুখোমুখি আমরা।’
মহাসচিব বলেন, ‘এর ভয়াবহ পরিণতি হবে। এর শুরু খাদ্য রেশন ব্যাপকভাবে কমানো। এটি একটি অবিরাম বিপর্যয় হবে। মানুষ কষ্ট পাবে এবং মানুষ মারা যাবে।’
সম্ভাব্য এই বিপর্যয় এড়ানোর সুযোগ দিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে বাংলাদেশ এবং অন্যদের সঙ্গে কাজ করার জন্য জাতিসংঘ পুরোপুরি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা তাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছাসেবী, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করবে। আমি জানি, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনের পরিকল্পনাও জোরদার করছে।
মায়ানমার প্রসঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘আমরা জানি, সেখানে পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যসহ মায়ানমারজুড়ে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে বেসামরিক জনগণের হতাহতের ঘটনা ঘটছে। অভ্যন্তরীণ ও সীমান্ত পেরিয়ে বাস্তুচ্যুতি ঘটছে।’
আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘আমি মায়ানমারের সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সহিংসতার আরো উসকানি রোধ করার আহবান জানাচ্ছি। এগুলো গণতন্ত্রের শিকড় গজানোর পথ প্রশস্ত করবে।’
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘আমরা যখন রমজানের এই পবিত্র মাসে একত্রিত হচ্ছি, তখন সংহতি ও মানবতার অংশীদারির ব্যাপারে মনোনিবেশ করা আগের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই চেতনায় সামনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা এবং সুযোগগুলো কাজে লাগানোর সময় আমরা বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকব।’
এই রমজান সবার জন্য শান্তি, আশীর্বাদ ও নতুন আশা বয়ে আনবে বলে আশা করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর সরকার এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে অর্থবহ। জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা জনগণের সঙ্গে তাঁর পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেছেন। তিনি মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং অধিকারের সঙ্গে তাদের মায়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা বোঝার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব যুবসমাজ, নাগরিকসমাজ এবং সংস্কার কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে তিনটি বৈঠকে যোগ দেন। তাদের অবদান জুলাই সনদের পথ প্রশস্ত করছে, দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের নীলনকশা এবং রাজনৈতিক, বিচারিক, নির্বাচনী, প্রশাসনিক, দুর্নীতিবিরোধী এবং পুলিশ সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করছে।
মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, এই সফরে জাতিসংঘ মহাসচিব জানতে পারেন যে রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে, তাদের পরিচয় সমুন্নত রাখতে, তাদের মালিকানাধীন ভূমিতে তাদের অধিকার উপভোগ করতে এবং তাদের বিবেচনায় মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে কতটা মরিয়া। তারা স্পষ্টভাবে বলেছে, তারা কক্সবাজারে আশ্রয়শিবির নয়, পূর্বপুরুষের ভূমি রাখাইনে মর্যাদাপূর্ণ জীবন দেখতে পায়। তারা বলেছে, ‘একটি পোকামাকড়েরও নিজস্ব ঘর আছে, কিন্তু আমাদের নেই।’ এভাবে তারা নিজেদের জন্য স্বেচ্ছাসেবা এবং মর্যাদাকে সংজ্ঞায়িত করেছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন তাদের কী উত্তরাধিকার ছিল তাও জানতে পেরেছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশের ‘প্রকৃত রূপান্তর’ এর জন্য সংস্কার প্রক্রিয়ার তিনি প্রশংসা করেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরো বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি জাতিসংঘের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য যা কিছু করতে পারেন তা করবেন এবং বাংলাদেশ ও এর জনগণের পাশে থাকবেন।
মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁর সফর ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা এবং বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করার চেয়েও বেশি কিছু করবে। তাঁর সমর্থনের আশ্বাস, আমাদের সফল সংস্কারপ্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের সাধারণ আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ গণতন্ত্রে উত্তরণে সহায়তা করবে।’
চার দিনের সফরে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসেন। গত শুক্রবার তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কক্সবাজার সফর করেন। সেখানে তাঁরা লাখো রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতারে অংশ নেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশ সফর শেষে আজ রবিবার সকালে ঢাকা ছাড়বেন।