সম্প্রতি ইসরায়েলের সুপরিকল্পিত হামলায় ইরানের সামরিক এবং পরমাণু স্থাপনার বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। নিহত হয়েছেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাগেরি এবং ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-এর প্রধান হোসেইন সালামি।
এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলা ইরানকে এখন পরমাণু অস্ত্র অর্জনের পথে আরও দ্রুত এগোতে বাধ্য করতে পারে।
পরমাণু কৌশলে বড় পরিবর্তনের শঙ্কা
আন্তর্জাতিক সংকট গবেষণা সংস্থার (ICG) ইরান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলি ভায়েজ জানান, এই হামলা ইরানকে প্রতিরোধমূলক পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনে আরও দৃঢ় করে তুলতে পারে। তিনি বলেন, ইসরায়েল জানে— এ ধরনের হামলার একটি দীর্ঘমেয়াদি ফল হতে পারে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে আরও গোপনে ও দ্রুত এগিয়ে নেওয়া।
কূটনৈতিক উদ্যোগের ইতি?
বিশ্লেষক রেজা আকবারি মনে করেন, এই হামলা ইরানের ভেতরের সংস্কারপন্থী ও কট্টরপন্থীদের মধ্যে চলমান বিতর্কে কট্টরপন্থীদের পক্ষে বড় বিজয় এনে দিয়েছে। ‘তারা সবসময় বলেছে— পশ্চিমা বিশ্বকে বিশ্বাস করা যায় না। কূটনীতি সময়ের অপচয়। হামলার পর এই যুক্তি আরও শক্তিশালী হয়েছে’ বলেন আকবারি।
২০১৫ সালের ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে সরে দাঁড়ান। এরপর থেকেই ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বর্তমানে ট্রাম্প আবারও চুক্তির পক্ষে কথা বললেও বাস্তবে তিনি ইরানকে ‘চূড়ান্ত ধ্বংসের’ হুমকি দিয়েছেন। Truth Social-এ দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প বলেন, ‘চুক্তিতে না এলে ইরানের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।’
জোট ভেঙে পড়ছে, প্রতিরোধ দুর্বল হচ্ছে
ইরান অতীতে তার আঞ্চলিক ‘প্রতিরোধ জোট’ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। এই জোটে ছিল হিজবুল্লাহ, সিরিয়া ও অন্যান্য গোষ্ঠী। কিন্তু হিজবুল্লাহ সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর সেখানকার প্রভাবও অনেকটাই হারিয়েছে ইরান।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিরক্ষা থিঙ্কট্যাংক RUSI-এর গবেষক মাইকেল স্টিফেন্স বলেন, এখন ইরানের সামনে দুই পথ— হয় চুক্তিতে রাজি হতে হবে, নয়তো ইসরায়েল আরও হামলা চালাবে এবং উচ্চ পর্যায়ের হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকবে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ইরান যদি এখন বোমার দিকে ছুটে যায়, তাহলেও সেটা আর সহজ হবে না। কারণ তাদের সক্ষমতা ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত।
গাদ্দাফির পরিণতি ইরানের সামনে সতর্কবার্তা
সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির (CIP) ইরান বিষয়ক বিশ্লেষক নেগার মরতাজাভি বলেন, লিবিয়ার গাদ্দাফির পরিণতি ইরানের নেতাদের মাথায় সবসময়ই আছে। গাদ্দাফি ২০০৩ সালে মার্কিন চাপের মুখে পারমাণবিক কর্মসূচি ছেড়েছিলেন, কিন্তু ২০১১ সালে পশ্চিমা সমর্থনে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে নিহত হন।
‘ইরান বিশ্বাস করে— পারমাণবিক সক্ষমতা না থাকলে তারা গাদ্দাফির মতো দুর্ভাগ্য বরণ করবে,’ বলেন মরতাজাভি।
শেষ কথা
বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের সামনে এখন কার্যত কোনো সহজ পথ নেই। একদিকে আন্তর্জাতিক চাপে নতি স্বীকার, অন্যদিকে পারমাণবিক পথে হাঁটার ভয়ংকর পরিণতি। কিন্তু ইসরায়েলের এই হামলা যেন পরিস্থিতিকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখান থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন। বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে— ইরান কোন পথ বেছে নেয়। সূত্র-আল জাজিরা