ঢাকা
১৯শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সন্ধ্যা ৬:৪৯
logo
প্রকাশিত : অক্টোবর ১৮, ২০২৫

প্রাথমিক থেকেই দুর্বল ভিত্তি হয় ইংরেজির

দেশে বিদ্যালয়ের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ইংরেজি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক। উচ্চশিক্ষার আগে দীর্ঘ ১২ বছর শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বিষয়টি পড়তে হয়। তবে দেশের অধিকাংশ স্কুলে এখনো ইংরেজি শেখানোর পদ্ধতি মুখস্থ নির্ভর। আর যে বিষয়টা জীবন থেকে আহরিত না হয়ে মুখস্থ করা হয়, সে বিষয়টা মাথা থেকে খুব দ্রুত চলে যায়। এ কারণে এক যুগ ধরে পড়ালেখা করেও অনেক শিক্ষার্থীর ইংরেজিভীতি কাটেনি।

যার বাস্তব প্রতিফলন দেখা গেছে এবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে। অকৃতকার্য ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশেরই ইংরেজিতে ভরাডুবি হয়েছে। ইংরেজিতে পাশের হার ৭৭ শতাংশ থেকে কমে ৫৮ শতাংশে নেমেছে, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, পাঠ্যদানে অদক্ষ শিক্ষকের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই তৈরি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ইংরেজির দুর্বলতা। মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোর ৮৪ শতাংশ ইংরেজি শিক্ষকের নেই ইংরেজিতে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। অর্থাত্ এবার ফল বিপর্যয়ের নেপথ্যে রয়েছে দক্ষ শিক্ষকের অভাব।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশনের ২০২৩ সালে করা একটি জরিপে দেখা যায়, প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের একটি বর্ণও পড়তে পারে না প্রায় ১৬ ভাগ শিক্ষার্থী। আর ৮৪ দশমিক ১৫ শতাংশ ছেলেশিশু এবং ৮২ দশমিক ৮৬ শতাংশ মেয়েশিশু তিনটি বা তার কম ভুল উচ্চারণসহ একটি কাহিনী সাবলীলভাবে পড়তে পারে না। শুধু বেসরকারি সংস্থার তথ্যই নয়, শিক্ষার্থীদের এ দুর্বলতার তথ্য উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সরকারি প্রতিবেদনেও। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষাজীবনে ১২ বছরের বেশি ইংরেজি পড়েও অনেকে ভাষাটিতে সাধারণ কথোপকথন চালাতে পারে না।

সাধারণ বাক্য গঠনে হিমশিম খায়। গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, অষ্টম শ্রেণিতে ইংরেজি বিষয়ে ভালো ও খুব ভালো শিক্ষার্থীর হার ৪৬ শতাংশ। দশম শ্রেণিতে হারটি ৬১ শতাংশ। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এবং মাউশির মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন উইং থেকে করা জরিপে উঠে এসেছে, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে ভীষণ দুর্বলতা নিয়ে মাধ্যমিকের গন্ডি পার হচ্ছে। শিক্ষাবিদদের মতে, একটি শিশুর ইংরেজির ভিত্তি তৈরি হয় মূলত প্রাথমিক স্তরেই, তবে অদক্ষ শিক্ষক দিয়ে পাঠদানে শিক্ষার্থীদের ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়েই।

৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাশের হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০২১ সালে পাশের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ, ২০২২ সালে ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ২০২৪ সালে ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ, আর এবার ২০২৫ সালে এসে তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশে। গত পাঁচ বছরে পাশের হার কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। পাঁচ বছরের ফলাফল তুলনা করে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা প্রায় প্রতি বছরই অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় ইংরেজিতে খারাপ ফলাফল করেছে। ইংরেজিতে ফেল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক বলেন, শিক্ষার্থীদের ইংরেজি-ভীতি, শিখন পদ্ধতির জটিলতা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাবই শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে খারাপ ফলাফলের অন্যতম কারণ। শুধু শিখন পদ্ধতি কিংবা প্রশিক্ষিত শিক্ষকই নয়। দেশের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি এবং বেতন কাঠামোসহ অন্যান্য বিষয়ও এর সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, ‘‌শিক্ষার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ, মেধাবী মানুষ প্রয়োজন। আমাদের এখানে ইংরেজির মান ভালো না হওয়ার কারণ উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও দুর্নীতিসহ নানা রকম বিষয় কাজ করে। পাশাপাশি শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন সেটি নেই। শিক্ষকদের বেতন পর্যাপ্ত নয় এবং তারা উপযুক্ত সম্মান পান না। ফলে শিক্ষায় যে মেধাবী মানুষ আকৃষ্ট হবে সেটি ঘটছে না।’

আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নেন ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাশ করেছেন ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন। গড় পাশের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে ইংরেজি, হিসাব বিজ্ঞান ও আইসিটিতে। এর মধ্যে এবার বেশি ফেল করেছেন হিসাব বিজ্ঞানে। এবার এই বিষয়ে ফেল করেছেন ৪১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অবশ্য শুধু বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য হিসাব বিজ্ঞান বিষয়টি থাকে। ইংরেজিতে ফেল করেছেন ৩৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এই বিষয়ে ঢাকা ও বরিশালে পাশের হার ৭০ শতাংশ হলেও বাকি বোর্ডগুলোতে তা ৬০ শতাংশের নিচে। সবচেয়ে খারাপ করেছে যশোর বোর্ডে। এই বোর্ডে ইংরেজিতে পাশ করেছে মাত্র ৫৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর আইসিটিতে ২৭ দশমিক ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছেন। বোর্ডগুলো আরো জানাচ্ছে, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে নম্বর পাওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে ফেলও এবার বেড়েছে।

এমন পরিস্থিতির কারণ হিসেবে শিক্ষাবোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষায় সহানুভূতির নম্বর বা অতিরিক্ত নম্বর দেওয়ার প্রচলন ছিল। এতে অনেক শিক্ষার্থী সীমিত প্রস্তুতি নিয়েও পাশ করতেন। কিন্তু এবার সেই নম্বর পুরোপুরি বন্ধ করে কঠোরভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। ফলে প্রকৃত সক্ষমতার প্রতিফলন এসেছে ফলাফলে। সেই সঙ্গে মফস্বলের কলেজগুলোতে অনলাইন বা ডিজিটাল কনটেন্টভিত্তিক পড়াশোনার অভাব, শিক্ষকের ঘাটতি এবং পরীক্ষার্থীদের দুর্বল লেখনশৈলী ফলাফলের ওপর বড় প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিল থেকে দূরে সরে গেছে বলেও মনে করা হচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে একটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি ইংরেজি পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল বলেন, অনেক শিক্ষার্থীর ইংরেজি বিষয়ের উত্তরপত্রের দিকে তাকালেই প্রথম যে বিষয়টি চোখে পড়ে, তা হলো অর্থহীন ও অসংলগ্ন লেখা। সঠিক বাক্য গঠন ও মৌলিক ব্যাকরণ কোনোটিরই উপস্থিতি নেই। ইংরেজিতে বানান ভুল এত বেশি যে, তা পড়তে গিয়ে পরীক্ষকদের মাথা ঘুরে যায়। অনেক সময় মনে হয়, তারা যেন কখনো কলেজে যায়নি, কোনো বই কেনেনি। কারণ, তারা জানেই না কীভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এমনকি একটি পূর্ণাঙ্গ বাক্যও সঠিকভাবে লিখতে পারে না। ই-মেইল, চিঠি, দরখাস্ত বা অনুচ্ছেদ লেখার মৌলিক নিয়ম সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা নেই। কখনো কখনো ৫০টি খাতার পুরো একটি বান্ডিলেই এ ধরনের হতাশাজনক পারফরম্যান্স দেখা যায়। মনে হয়, শিক্ষার্থীরা ইংরেজিকে বোঝার পরিবর্তে মুখস্থ বিদ্যা কাজে লাগিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে।

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ এডভোকেট মো: গোলাম সরোয়ার
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2025 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram