ছায়েদ আহামেদ, হাতিয়া (নোয়াখালী) প্রতিনিধি: নোয়াখালীর হাতিয়া পৌরসভায় লোকাল গর্ভমেন্ট কোভিড-১৯ রেসপন্স ও রিকভারি (এলজিসিআরআরপি) এবং গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন(আইইউআইডিপি)সহ এডিপি প্রকল্পে চরম অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে উপ-সহকারী প্রকৌশলী(এস.এ.ই) মো. সেলিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে।
সিএস-অফিস খরচ ও ল্যাব টেস্টের নামে ঠিকাদারদের থেকে লাখ-লাখ টাকা নেওয়া, চাহিদামতো ঘুষ নিয়ে এস্টিমেট ব্যতিরেকে অতি নিম্নমানের কাজ করানো, নিজেই ঠিকাদার বনে গিয়ে কাঁড়ি কাড়ি টাকা কামানো, রোলার চার্জ, প্লান অনুমোদনের নামে পৌরবাসী থেকে ইচ্ছেমতো টাকা নেওয়াসহ নানান দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে এস.এ.ই. সেলিম কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
২০২০ সালের শেষে তিনি হাতিয়া পৌরসভা অফিসে এস এ ই পদে যোগদান করেন। ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারিতে হাতিয়া পৌরসভা নির্বাচনে নতুন মেয়রের(কেএম ওবায়দুল্লাহ) সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে নিজেকে বড্ড আওয়ামীলীগার বানিয়ে নেন সেলিম। এসময় নিয়মবহির্ভূত বহু সুবিধাও নিয়েছেন বলে জানান পৌর অফিসের একাধিক স্টাফ ও ভুক্তভোগীরা। গেল বছরের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনে নতুন সুরে পথ চলেন তিনি। চাকরিচ্যুত পরিচ্ছন্নতা কর্মী রাশেদ উদ্দিন, সুইপার ও বহিরাগতদের সাথে রেখে দাম্ভিক ও ক্যাডার স্টাইলে চালান অফিস। যদিও পৌর প্রশাসকের দায়িত্বে আছেন সহকারী কমিশনার(ভূমি)। এস.এ.ই. মো. সেলিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে এহেন পাহাড়সম অভিযোগের ভিত্তি সম্প্রতি সরেজমিন অনুসন্ধানে নামে প্রতিবেদক।
হাতিয়া পৌরসভা অফিসের তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় হাতিয়া পৌরসভায় ১৮টি প্রকল্প গ্রহন করা হয়। যার বরাদ্দ এক কোটি ৪৭ লাখ টাকা প্রায়। সবকটি প্রকল্পে এস্টিমেটের তোয়াক্কা না করে চাহিদামতো পার্সেন্টেজ নিয়ে কাজের মনগড়া পরিসমাপ্তি দেখিয়ে বিলের ব্যবস্থা করেন এস.এ.ই. মো. সেলিম উদ্দিন। প্রকল্পসমূহের সরেজমিন অনুসন্ধানে গেলে- পৌরসভা ০১ ওয়ার্ড রহমত আলী রোডের মাথা বক্সকালবার্টটির এস্টিমেটে- দু'পাশের দেয়াল মাটি থেকে যথাক্রমে ২০ ইঞ্চি, ১৫ ইঞ্চি, এবং ১০ ইঞ্চি ঘাতনি দিয়ে করার কথা। কিন্তু সেক্ষেত্রে মাটি থেকে শুধু দশ ইঞ্চি ঘাতনী দিয়ে কোনোপ্রকারের ফিনিশিং ছাড়াই কাজটি শেষ করা হয়।
পুরাতন কোর্ট সংলগ্ন হুমায়ুন হোটেলের সামনের রাস্তাটির কাজ সমাপ্তির দেড় মাসের মাথায় পূর্বাংশটি ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে যায়। এস এ ই সবগুলো কাজে অতিরিক্ত হারে ঘুষ নেওয়ায় কাজের মান এমন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এস.এ.ই. সেলিম এডিপি প্রকল্পের সবগুলো কাজে ঠিকাদারদের থেকে ল্যাব টেস্ট নামে ২ পারসেন্ট, সিএস খরচ নামে ২ পারসেন্ট এবং অফিস খরচ নামে ৫ পারসেন্ট ছাড়াও বিভিন্ন সময় নানা অযুহাতে মোট ১০ পারসেন্ট টাকা নিয়েছেন বলে জানান প্রায় সব ঠিকাদার। সে হিসেবে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এছাড়া এডিপির এ প্রকল্পসমূহের অনেকগুলো কাজ অসমাপ্ত রেখে ঠিকাদারদের সাথে যোগসাজশে সমপরিমাণ টাকা ভাগ নিয়েছেন বলে জানা যায়। ঠিকাদার'রা জানান, ল্যাব টেস্টের প্রচলন এবারই প্রথম। সিএস এবং অফিস খরচ অতীতে আরো কম নিতো। এস.এ.ই তাদের উপর জুলুম করেছেন বলে জানান এসব ভুক্তভোগীরা।
এডিপির এই কাজগুলো প্রকল্পভুক্তকরণ তথা প্রতিটি প্রকল্প পাসে এস.এ.ই সেলিম ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পার্শ্ববর্তী সেবাগ্রহীতাদের থেকে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ সম্পর্কে পৌরসভা ০১নং ওয়ার্ড 'ছেরাজল হক রোড'র পার্শ্ববর্তী একাধিক সেবাগ্রহী বাসিন্দা জানান, এস.এ.ই সেলিম কে তারা ২০ হাজার টাকা দিয়ে অনেকদিনের প্রত্যাশিত রাস্তাটি প্রকল্পভুক্ত করেছেন।
পৌরসভা এলাকায় যে কয়টা ছোট-বড় মার্কেট হয়েছে এবং একতলা চাদঢালাই কিংবা দ্বিতল ভবনের বাসা হয়েছে- তাদের থেকে ল্যাব টেস্ট এবং প্লান অনুমোদনের কথা বলে ৭০ থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন এস.এ.ই সেলিম। মালিকপক্ষ জানান, তাদের নাম প্রকাশ করলে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়ে দিবে পৌরসভা অফিস। তাই নাম প্রকাশে আপত্তি জানান তারা।
এদিকে, এলজিসিআরআরপি এবং আইইউআইডিপি'র আওতায় হাতিয়া পৌরসভায় প্রায় ৭ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহন করা হয়। এসব প্রকল্পের কাজেও চাহিদামতো ঘুষ নিয়ে এস্টিমেট ব্যতিরেকে এস.এ.ই তার মনগড়ামতো কাজ করিয়েছেন। প্রকল্পসমূহের ৬ জন ঠিকাদারের সাথে প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা জানান, ৫ পারসেন্ট ছাড়াও, ওয়ার্ক অর্ডার, সিএস-অফিস খরচ মিলে ১০ পারসেন্ট হারে এলজিসিআরআরপি এবং আইইউআইডিপি প্রকল্পসমূহে সবার থেকে ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এস.এ.ই সেলিম। সাইড ভিজিটেও যার থেকে যেভাবে পেরেছেন টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
তারা আরো জানান, একদিনে রোলার খরচ ৮হাজার এবং জ্বালানি-ড্রাইভার খরচ আরও দেড় হাজার টাকা করে নেন এস.এ.ই সেলিম।
উল্লেখিত প্রকল্পসমূহে কেউ কাজ কিনে নিয়েছেন আবার কেউ অন্যের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে নিয়েছেন। চলমান কিছু বিল আটকে থাকায় তারা আপাতত নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসবের তদন্তে আসলে তারা আলাদাভাবে সব অনিয়ম প্রকাশ করে দেবে।
ঠিকাদারদের থেকে আনডকুমেন্টারি কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কিছু তথ্য প্রমাণও পাওয়া যায় পৌর অফিস অনুসন্ধানে। যেখানে রোলার চার্জ ৫শো, এক হাজার টাকা মাত্র রাজস্বে জমা দেওয়ার খবর পাওয়া যায়।
জালজালিয়াতির অভিযোগে(গত সরকার পতনের তিন মাস আগে) চাকরিচ্যুত হওয়া রাশেদকে কাছে টেনে তার মাধ্যমে একাধিক প্রকল্পের ঘুষ ও পার্সেন্টেজ আদায় করতেন এস.এ.ই সেলিম। এ ক্ষেত্রে রাশেদও তার বাড়ির ৩/৪ জন আত্মীয়কে এস.এ.ই সেলিমের দুর্নীতির কাজে সাপোর্ট ও সাহস জোগাতেন রাশেদ। যা ইতোপূর্বে কয়েকটি প্রতিবেদনেও প্রকাশ পায়।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, লোকাল গর্ভমেন্ট কোভিড-১৯ রেসপন্স ও রিকভারি (এলজিসিআরআরপি) প্রকল্পের আওতায় এম আলী রোড(ফজলি বাড়ি)'র কার্যাদেশ পাওয়ার আগে ঠিকাদার মৃত্যুবরণ করেন। ঠিকাদার বা তার অন্য কোন প্রতিনিধি ছাড়া এস.এ.ই মো. সেলিম উদ্দিন নিজেই ঠিকাদার সেজে চলতি বিল উত্তোলন করেন। নিজে ঠিকাদার হয়ে ৬ ইঞ্চি সাব-বেজ এর স্থলে মাত্র ২ ইঞ্চি করেন। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট এই রাস্তাসহ সবপ্রকল্পের অনিয়ম, দুর্নীতি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জোর দাবি করেন ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট সেবা প্রত্যাশীরা।
পৌরসভা অফিসের কার্য সহকারী রেজাউল হাসান বলেন, "প্রকল্পের কোনো কাজ সম্পর্কে তাকে জানানো হয়নি ইঞ্জিনিয়ার সেকশন থেকে।"
প্রকল্পের এসব কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি সম্পর্কে এস.এ.ই মো.সেলিম উদ্দিনের সাথে ১৬ জুন মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি জানান, এসব বিষয়ে তিনি ফোনে কথা বলতে রাজি নন। ১৮ জুন অফিসে এসে কথা বলবে বলে জানান তিনি। অথচ ১৮ জুনও তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। পরে মোবাইলে বার-বার কল দিয়ে তার ফোন বন্ধ থাকায় আর যোগাযোগ করা যায়নি।
এসব বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন জানান, পৌরসভা প্রশাসক আসার পর বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন।